মুশফিক হোসাইন
মানসিক অসুস্থ লোকজনকে সমাজে পাগল নামে ডেকে থাকে। বাংলা প্রবাদে আছে ‘পাগলে কিনা বলে, ছাগলে কিনা খায়। আবার চাটগাইয়া প্রবাদ’ পঅলের কামন ছিন্নি খঅন’। তার মানে মানসিক অসুস্থ্য লোকজন সমাজে অপাংতেয়, মূল্যহীন ইত্যাদি ইত্যাদি। বিখ্যাত খনার বচনে আছে ‘ক্ষেত আর পুত/যত্ন বিনে যমদূত’। খনা মানুষ তথা’ পুত্রের যত্ন নেওয়ার কথা শত শত বছর আগে বলে গেছেন। যত্ন শুধু পুতের নিলে হবে না। নিতে হবে সমাজে প্রায় অবহেলিত বুড়ো তথা প্রবীণদেরও। চাটগাঁইয়া প্রবাদে আছে ‘বুড়া আর গুরা হোয়াইন্যা’। অর্থাৎ বুড়োরা শিশুর মতো। তাদেরও যত্ন আর্তি প্রয়োজন আছে। বক্ষমান লেখার প্রতিপাদ্য প্রবীণদের প্রতি যত্ন নেয়া বনাম অতি যত্নে প্রাণ ওষ্ঠাগত বিষয়ক। বর্তমান সমাজে প্রবীণ তথা পিতা মাতা অর্থাৎ মুরব্বীদের অবহেলার নজীর ভ‚রি ভ‚রি। আবার এমনও পরিবার আছে মুরব্বীদের আদর যত্ন সেবা মাত্রাতিরিক্ত। বলা চলে তাদের যত্ন আর্তির শেষ নেই।
প্রথমেই দু’একটি উদাহরণ দেয়া যাক; প্রথমত: আমার বন্ধু ‘ক’ সম্প্রতি হাসপাতাল থেকে বাসায় সুস্থ হয়ে ফিরেছেন। তাঁর পরিবার পরিজন চিকিৎসক ও অতিউৎসাহীদের পরামর্শ মতে যত্ন আর্তি করছেন। এটা খাওয়া ওটা না খাওয়া আট থেকে ৯ ঘণ্টা বিশ্রাম বা ঘুমাতে হবে। বাইরে যাওয়া বা আড্ডা দেওয়ার উপর বিধি নিষেধ। মাঝে মধ্যে এক কাপ দুধ চা কিম্বা দু-একটু করো বিপ ইত্যাদি সব নিষিদ্ধ। বিশেষ করে তাঁর যে এখন বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেওয়ার প্রয়োজন। তাঁর মন এখন অনেক কিছু চায়, তা সম্পূর্ণ ভাবে রহিত করা হয়েছে। বলা চলে তাঁকে নতুন একটি ছকে জীবন যাপন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। অতি যত্ন এখন তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময় তিনি কাজে কারবারে, সামাজিক দায় দায়িত্বে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। আক্ষরিক অর্থে তিনি এখন বন্দী। তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা মন মননের কোন মূল্য দেয়া হচ্ছে না। পরিবার পরিজন তাঁর সুস্থতা ও মঙ্গলের জন্যই বেশি বেশি যত্ন নিচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা ভুলে গেছেন- তিনি চাবি দেয়া কোন পুতুল নয়। রক্ত মাংসে গড়া একজন সংবেদনশীল মানুষ। তাঁর একটি স্পর্শকাতর মন আছে। সে কী আমরা বুঝি!
দ্বিতীয় উদাহরণ ; মি স তিনি তার পুত্র। পুত্রবধূ ও নাতির সাথে শহরে বসবাস করেন। ছেলে ও তার বউ চাকরীজীবী। নাতিকে স্কুলে আনা নেওয়া, বাজার সদাই তিনিই করেন। এবার দুর্গোপূজোয় ছেলে শ্বশুর বাড়িতে যেতে চাইলো, বাবা বললেন, নিজের বাড়িতে চলো। এই নিয়ে পিতাপুত্র বাদানুবাদ এবং অন্যান্য। তারা দু’পক্ষ পূজোর আনন্দ মাটি করে দু’দিকে চলে গেলেন। মি স এর স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় একযুগ। তিনি এখন গ্রামের বাড়িতে একা। নিজে নিজের কেয়ার টেকার।
দু’টি ঘটনার উদাহরণ দেয়া গেল। প্রবীণদের সাম্প্রতিক কালের দুই ভিন্নধর্মী জীবনাচরণ। কার্যতঃ দু’পক্ষেরই মানসিক সুস্থথা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যা হলো মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি। এজন্য চিকিৎসা নয় পরিবারের সদস্যদের জন্য পরিচর্যা বা কাউন্সিলিং প্রয়োজন। পরস্পরের বোঝা পড়ার অভাব। পরিবার তথা সন্তানদের বুঝতে হবে। প্রবীনদের মন মানসিকতা! তাই আমাদের জানতে হবে ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ বলতে কি বোঝায় ?
‘মানসিক স্বাস্থ্য হলো- আবেগ ও আচরণ। যা মানব জাতির চিন্তা, অনুভূতি এবং জীবন যাপনের পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে। অতএব জীবনের চাপ মোকাবেলা, অন্যদের সাথে সুস্থ্য সম্পর্ক রাখা এবং নিজের সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করার ক্ষমতাকে বোঝায়। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক সুস্থতার জন্য নিয়মিত খাওয়া, পানি পান, পর্যাপ্ত ঘুমের মতো রুটিন মেনে চলতে হবে। এজন্য প্রশিক্ষিত এবং পেশাদার বিশেষজ্ঞের সাথে ব্যক্তিগত বা পেশাগত সমস্যা নিয়ে আলোচনা প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার কোন বিকল্প নেই। ফলে মানসিক ক্ষমতা, জৈবনিক কার্যকলাপ এবং মানষিক সক্ষমতা অর্জিত হবে। এই কাউন্সিলিং যথাযথ ভাবে সম্পন্ন হলে মানসিক স্বাস্থ্যের ভারসাম্য তৈরী হবে। এই পরিচর্যায় গুরুত্ব পায় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য, ব্যক্তিগত দর্শন, বিষয়গত মূল্যায়ন ইত্যাদি।
যদি না মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারিত্বের সাথে মূল্যায়ন করা না হয় তা হলে একজন ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন, ঘুমে সমস্যা, শক্তির অভাব দুর্বলতা বোধ করা তৃষ্ণা মন্দা, ক্ষুদামন্দা নিজের বা অন্যের অকল্যাণ চিন্তা, আত্ম বিছিন্নতা (অন্তর্মুখীতা এবং একাকীত্ব সব সময় অস্বাস্থ্যকর নয়) মাঝে মধ্যে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ইত্যাদি।
মনে রাখতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা আর মানসিক রোগ এক বিষয় নয়। মানসিক রোগ হল, ক্রমাগত দুঃখ বা শুন্যতা বোধ করা, মেজাজের চরম পরিবর্তন, অতিরিক্ত অপরাধ বোধ বা আত্মবিশ্বাসের অভাব, অমনযোগী হওয়া, সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হওয়া, ভুলে যাওয়া বা কোন বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করা ইত্যাদি।
অতএব এই বাস্তবায় প্রতিটি পরিবারে, সমাজে প্রবীণদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে অতীব গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় ব্যক্তিজীবনে অথবা পারিবারিক জীবনে কোন কোন ক্ষেত্রে সমাজ ও দেশের চরম মূল্য দিতে হবে। পরিবার ও সমাজকে বুঝতে হবে ব্যক্তির স্পর্শিকাতরতা কোথায় অতি আদর যত্ম যেমন একজন ভুক্তভোগীর জন্য গ্লানি ও দুঃখ ডেকে আনতে পারে। তেমনি অযত্ন, বিচ্ছেদ থেকে জন্ম নিতে পারে হতাশা, স্বাস্থ্যহানি, আত্মঘাত। অতএব আসুন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করি। একজন ব্যক্তিকে তাঁর নিজের মতো করে বাঁচতে দিন। নিজেরা ও বাঁচুন।
লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)











