মানব পাচার এখন ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে উদ্বেগজনকভাবে। মানব পাচার সংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি সংস্থার জরিপে এসেছে বাংলার গ্রামীণ জনপদের সহজ সরল মানুষ নানা প্রলোভনের শিকার হয়ে অধিক আয়ের জন্য ইউরোপ আফ্রিকায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে। পাচারকারিরা শুধু বুঝে তাদের স্বার্থ হাসিলের কাজটি সেরে নেয়। সরকার অবশ্যই মানব পাচার রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। কিন্তু কোনোভাবেই তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো মানব পাচারকারী ধরা পড়ছে। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে মূল অপরাধীরা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের বেশির ভাগই প্রভাবশালী। এ প্রভাবশালীরাই নিয়ন্ত্রণ করছে মানব পাচারের সিন্ডিকেট। মানব পাচারের ব্যবসার পাশাপাশি তারা রাজনীতিতেও জড়িত। মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা মানব পাচারে সক্রিয় হয়ে উঠছে। মানব পাচার বৃদ্ধির পেছনে বিচারহীনতা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাও বড় কারণ। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের মানব পাচার প্রটোকল ২০০০-এর নির্দেশনা অনুযায়ী পাচারকারীদের দ্রæত বিচারের আওতায় আনতে হবে। যেসব মামলা চলমান রয়েছে, সেখানে শক্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে সক্রিয় হতে হবে। যতক্ষণ না অপরাধীদের বিরুদ্ধে জোরালো আইনি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে ততক্ষণ পাচার একটি কম ঝুঁকির ও উচ্চ লাভের কাজ হিসেবেই বিদ্যমান থাকবে। অবশ্যই এর পরিবর্তন দরকার। মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের কার্যক্রমগুলোকে ভুক্তভোগী-সহায়ক করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে নারী-পুরুষ বা তরুণ-বয়স্ক সব ভুক্তভোগী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা পায়। এর অর্থ হলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দাতাগোষ্ঠীর ব্যাপক প্রচেষ্টার সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে ভুক্তভোগীদের সেবা জোরদার করার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে ভুক্তভোগীদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, চিকিৎসা এবং মানসিক, সামাজিক, আইনি ও পুনর্বাসন সেবাও নিশ্চিত করতে হবে।
মানব পাচার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তর ‘ট্রাফিকিং ইন পারসনস (টিআইপি) রিপোর্ট ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার বিগত বছরের তুলনায় সামগ্রিকভাবে ক্রমবর্ধমান প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান আগের দ্বিতীয় ধাপেই (টিয়ার-২) রয়ে গেছে। এ ধাপে বাংলাদেশের প্রতিবেশীদের মধ্যে রয়েছে ভারত, ভুটান ও শ্রীলংকা। মানব পাচার নির্মূলে যেসব দেশ ন্যূনতম মানদন্ড অর্জন করতে পারেনি কিন্তু উল্লেখযোগ্যভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেগুলোকেই এ ধাপে রাখা হয়েছে। প্রচেষ্টা সত্তে¡ও বাংলাদেশ সরকার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ন্যূনতম মান অর্জন করতে পারেনি।
গত বছরেও বাংলাদেশ একই অবস্থানে ছিল। মানব পাচার নির্মূলে বাংলাদেশের যেসব দুর্বলতা রয়েছে, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্যানাল ল, পুলিশ অ্যাক্ট, সিআরপিসি, এভিডেন্স অ্যাক্ট হয়েছিল মূলত লুণ্ঠন, শোষণ ও নিষ্পেষণের জন্য। যাতে বেঙ্গল ও ভারতবর্ষ থেকে সম্পদ ইংল্যান্ডে সহজে পাচার করা যায়। ১৮৬০ সালের আইন দিয়ে যদি ২০২৪ সালে বিচার করতে করা হয় তাহলে আইনের কঠোর প্রয়োগ সম্ভব না। কারণ এ আইন এখন ব্রিটেনেও নেই। এ আইনে যারা পাচারকারী তাদের সাজা হয় না। সাজা হয় মিডল ম্যানদের। তাই মানব পাচার আইনকে আরো যুগোপযোগী করে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। যাতে মূল অপরাধীদের বিরুদ্ধে শক্তভাবে ব্যবস্থা নেয়া যায়।
নিরাপদ মাধ্যমে বিদেশে কাজের জন্য গমনেচ্ছু ব্যক্তিদের সুরক্ষায় কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। এর মধ্যে থাকবে নিয়োগের জন্য আন্তঃসরকারি সমঝোতার মাধ্যমে ধার্য করা দাপ্তরিক ফি বাড়িয়ে নেয়া নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রযোজ্য আইনের প্রয়োগ অব্যাহত রাখা এবং এসব ফি কর্মীদের থেকে আদায় বন্ধ করে সেই ব্যয়ভার নিয়োগকারীদের ওপর বর্তানোর জন্য কাজ করা। যখন কোনো ব্যক্তি নিয়োগ ফি পরিশোধের জন্য ঋণ নেন, তখন তিনি শোষণের এক ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়েন। কর্মীদের শুরু থেকেই অসুবিধার মধ্যে ফেলা এ শুভংকরের ফাঁকির হিসাবের সম্পূর্ণ পরিবর্তন দরকার। নিরাপদ অভিবাসনের জন্য সহজ পথ তৈরি করতে নিয়োগকারীদের অবশ্যই আরো বেশি প্রচেষ্টা নিতে হবে।
দেশীয় দালাল চক্র এবং তাদের প্রশ্রয় দানকারী সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলে, কেবল মানব পাচার বন্ধ হবে। এই যে দালাল চক্র এবং তাদের প্রশ্রয় দানকারী, যারা রাজনৈতিক ক্ষমতার থেকে এসব অবৈধ কাজ চালিয়ে যেতে পারে, এদের প্রতিহত করতে হবে। দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে সরকারিভাবে মানব পাচারবিরোধী কমিটি রয়েছে। একে কার্যকর করে তোলা জরুরি।
দেশের সাধারণ দরিদ্র মানুষ তাদের দরিদ্রতার জন্যই অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমায়। এ কথা অনস্বীকার্য যে মানুষের প্রকৃত অর্থনৈতিক ও জীবনমানের উন্নয়ন না হলে এটি থামানো যাবে না। যেহেতু বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে, এজন্যই এটি বন্ধে সরকারকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি উদ্যোগে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোর সহায়তায় এ বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) পূরণে আমরা যদি শিশু ও মাতৃমৃত্যুহারের মতো একসময়ের কঠিন সমস্যা দূর করতে পারি, তাহলে সদিচ্ছা থাকলে এটিও করা যাবে নিঃসন্দেহেই। বৈধ পথে সরকার অনুমোদিত দেশগুলোয় শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য সহানুভূতিশীল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। মানব পাচারকারী দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে, অন্যদিকে সরকারি সহায়তায় গ্রামীণ অঞ্চলের প্রান্তিক দরিদ্র মানুষদের আত্মনির্ভরশীল করতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার স্বল্প ও বিনা সুদে ক্ষুদ্র ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণসহায়তা দিয়ে সাধারণ মানুষকে কর্মমুখী করে তুলতে সক্ষম হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাবলিক সিকিউরিটি ডিভিশনের ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন প্রিভেনশন অ্যান্ড সাপ্রেশন অব হিউম্যান ট্রাফিকিং (আপডেটেড ২০২৩-২৫) প্রতিবেদন অনুসারে, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ ও যশোর জেলা মানব পাচারের হটস্পট। দেশে মানব পাচার প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে আগামী দুই বছরের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে সরকার। শুধু কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করলেই হবে না, তা বাস্তবায়নেও জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশের মানব পাচারের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়েই ২০১২ সালে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান করা হয়। বর্তমানে দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। আজকাল ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই পাচারকারী ও তার অবস্থান শনাক্ত করা যায়। সামান্য মুঠোফোনের কল আর বিকাশের ট্রান্সফার ট্র্যাক করেই এসব করা সম্ভব এবং সে প্রযুক্তি স্থানীয় পুলিশের কাছে রয়েছে। আর সরকার যদি মোবাইল অপারেটর ও মোবাইল মানি ট্রান্সফারিং কোম্পানিগুলোকে বিগ ডাটা থেকে তথ্য দিতে বাধ্য করে তাহলে তো আর সমস্যাই নেই।
মানব পাচার মামলায় ৯০ দিনে অভিযোগ গঠন এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু ধীরগতির তদন্তের কারণে নির্ধারিত সময়ে নিষ্পত্তি সম্ভব হচ্ছে না। শক্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মামলা নিষ্পত্তিতে সরকারকে আরো সক্রিয় হতে হবে। কেননা দুর্বল তথ্যপ্রমাণের কারণে অনেকেই খালাস পেয়ে যাচ্ছেন।
পাচারকারীরা দেশের দরিদ্র মানুষের আর্থিক অসচ্ছলতাকে পুঁজি করছে। মানব পাচারের অপরাধের জন্য তাদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের ভালো ভাবমূর্তি রয়েছে। জাতীয় স্বার্থেই অভিবাসনের নামে মানব পাচার রুখতে হবে। এক্ষেত্রে কালক্ষেপণ না করে যত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যায় ততই মঙ্গল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একসঙ্গে গুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলে সুফল আসবে বলে আশা করা যায়।