মানব কল্যাণে স্বামী নারায়নপুরী

2

উত্তম কুমার চক্রবর্ত্তী

মানব জীবনে অন্ধকারের পাষাণকারা ভেঙ্গে নিখিল প্রাণগঙ্গায় আলোর দ্যূতি ছড়িয়ে দিতে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বিশ্বজননী দেবী দুর্গার অপার করুণার উপহার হিসেবে মা অনুরূপা দেবী কোল আলোকিত করে পেয়েছিলেন মানবমুক্তির মহাসাধক শ্রীমৎ স্বামী নারায়নপুরী মহারাজকে। পরম পুরুষ শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ ও শ্রীমৎ স্বামী অচ্যুতানন্দ পুরী মহারাজের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি মানবতার বাণী পৌঁছে দিয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। পরা ও অপরাবিদ্যার সেতুবন্ধনকারী এ মহান সাধক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ এম.এ ডিগ্রি অর্জন করা সত্ত্বেও পরমাত্মিক সম্পদ লাভে পরাবিদ্যার শ্রেষ্ঠত্বে বিচরণ করেছিলেন। গৃহাশ্রমে থেকে কিভাবে সংসার বন্ধন হতে মুক্ত হওয়া যায় তার সুমহান শিক্ষা স্বামীজী অমৃত কথামালার মাধ্যমে আমাদেরকে প্রদান করেছেন অত্যন্ত সুচারুভাবে। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এ অমৃততপা পুরুষ সহজেই সকল মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থান লাভ করতেন। সমাজের উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র এ ভেদাভেদ থেকে বেরিয়ে এসে বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মহানামের মহাপ্লাবণ সৃষ্টি করে সাম্য প্রতিষ্ঠায় এক কালজয়ী মহান পুরুষ ছিলেন তিনি। ভালবাসা বিশ্বকে জয় করতে পারে, নির্মাণ করতে পারে অহিংসার অভ্রভেদী মিনার, রচনা করতে পারে বিশ্বজনীন সমাজ এ বোধ হৃদয়ে লালন করে স্বামীজী মানব ধর্মের বৈজয়ন্তী নিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের বন্দরে পৌঁছে দিয়েছেন শান্তি ও মানবতার বাণী। গীতার শ্রেষ্ঠ উপদেশ “সর্বত্র সমদর্শন” এটি যেন তাঁর জীবনচর্যায় বাস্তব রূপ লাভ করেছে। স্বামীজী শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্যের প্রতিটি পর্যায়ে মানব ধর্মকে তিনি স্থান দিয়েছেন সবার উপরে। তাইতো তাঁকে বলতে শুনিÑ মানবসেবায় বড় ধর্ম। এটি তিনি নিজে করে করিয়ে দেখিয়েছেন লোকশিক্ষার জন্য। ছাত্রজীবনে গরীব বন্ধুদের বই, খাতা, কলম ইত্যাদি প্রদান আবার কারো ছাতা না থাকলে, নিজেরটাই দিয়েদিতেন অথচ বৃষ্টিতে নিজেই ভিজে আসতেন। এমনকি নিজের জমানো টাকা ও দরিদ্র শিক্ষার্থী বন্ধুদের দিয়ে দিতেন লেখাপড়ার খরচ চালাতে। এই ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ এ মহানসাধকের ছিল না। উদার মানবতাবাদের ব্যবহারিক প্রয়োগধারা এবং অর্ন্তমুখী জীবনানুশীলন এ দুয়ের সুসমন্বয় তাঁর আত্মাকে ঊর্ধ্বমুখী আনন্দের অভিষেক স্নানে শুচি করে তুলেছিল নিত্যদিন। উৎসবে-অনুষ্ঠানে যখন তিনি যেতেন তখন প্রতিটি অনুষ্ঠানে কিভাবে মানব কল্যাণের বার্তা দেওয়া যায় তার জন্য সচেষ্ট থাকতে স্বামীজী ভক্তদের নির্দেশনা প্রদান করতেন। উৎসব প্রসঙ্গে স্বামীজীর মহানবার্তা আজো হৃদয়কে আন্দোলিত করে, যা অনুসরণের মাধ্যমে আমরা প্রতিটি উৎসব অনুষ্ঠানকে সার্থক ও সফল করতে পারি। এ প্রসঙ্গে স্বামীজীর অমৃত বাণী হলো: “যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানে যদি মানব কল্যাণমুখী কর্মকান্ড থাকে তবে সেই উৎসব সার্থক হয়।” মানবতার এই নিত্য সাধকের কথা শিরোধার্য করে অদ্বৈত-অচ্যুত ভক্তরা আজো উৎসবের দিনগুলোতে আয়োজন করে যাচ্ছে দরিদ্র অসহায় পরিবারকে অন্নদান, বস্ত্রদান, রুগ্নদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের মতো মহৎ কর্মকান্ড। শুভ্র বস্ত্র পরিধান করে স্বামীজী যখন উৎসব অঙ্গনে হেঁটে যেতেন কিংবা বসে নামসূধা শ্রবণ করতেন তখন অসংখ্য ভক্তের মাঝে তাঁর দেহ থেকে বিচ্ছুরিত হতো এক প্রজ্ঞাতপোমন্ডিত দ্যুতি। এ যেন আঁধারের পারে মহানপুরুষের পদচারণা। উৎসব অঙ্গনে মহানাম সংকীর্তনের মধুরতা ও স্বামীজীর উপলস্থিতি সকল ভক্ত হৃদয়ে জাগাতো অপূর্ব প্রেমানুভূতি। তাইতো রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে:
“কী ধ্বনি বাজে
গহনচেতনা মাঝে !
কী আনন্দে উচ্ছ¡সিল
মম তনুবীনা গহনচেতনা মাঝে \”
যারাই স্বামীজীর সংস্পর্শে এসেছেন তারাই বলতে পারেন তিনি কতো মহৎ ও মহীয়ান। যুগে যুগে দেশে দেশে জ্ঞানতাপসেরা আসেন অথচ মানবাত্মার সত্য আকাঙ্খাকে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে আপন প্রাণের উত্তাপে রোপণ করার সাধনায় নিবেদিত প্রাণ মনিষীর সন্ধান খুব একটা বেশি মিলে না। শ্রীমৎ স্বামী নারায়ন পুরী মহারাজ ছিলেন তেমন এক অমৃততপা পুরুষ যিনি প্রশান্ত জ্ঞানে, ইন্দ্রধনু প্রজ্ঞায়, আকাশভরা ঔদার্যে এক মানবিক বিস্ময়। সমাজকে তিনি কেবল ভাবৈশ্বর্য দিয়ে যাননি। নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়েছেন মানব কল্যাণে। হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেই এক জাতি তথা মানবজাতি এ বোধ ও বিশ্বাস হৃদয়ে লালন করে ২০০৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত মানবিক প্রতিষ্ঠান ‘অদ্বৈত-অচ্যুত মিশন বাংলাদেশ।’ এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সমাজের হতদরিদ্র ও অসহায় মানুষের সেবায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অগ্নিকাÐে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদান, রুগ্ন ও অসহায় রোগীদের চিকিৎসাসেবা এবং রক্তদান, শীতার্থদের মাঝে সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ, ব্লাডগ্রুপ নির্ণয় ও বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ করে প্রতি বছর সুনামের সাথে স্বামীজীর আদর্শকে মাথায় নিয়ে মিশনের নিবেদিত প্রাণ কর্মকর্তারা ছুটে যান মানুষের বন্দরে সেবার মহান ব্রত নিয়ে। এ মিশনের মাধ্যমে স্বামীজী তীর্থযাত্রীদের সেবা পরিচালনা করারও ইচ্ছা পোষণ করায় কর্মকর্তারা প্রতি বছর তীর্থযাত্রীদের সেবা দিয়ে থাকেন, যা ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এ মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রতি বছর শিব চতুর্দশী তিথিতে সেবার মহান ব্রত নিয়ে ছুটে যান মিশনের নিবেদিত প্রাণ কর্মকর্তারা চট্টগ্রামস্থ সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ ধাম এবং বঙ্গোপসাগরের উপকুলবর্তী আদিনাথ ধামের সু-উচ্চ পাহাড়ে। অসংখ্য তীর্থযাত্রীদের পদচারণায় মুখরিত সেই মিলনমেলায় মিশনের কর্মকর্তারা কোমল পানীয়, চিকিৎসা সহায়তা ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী প্রদান করে সবার্থক সেবা দিয়ে মানব কল্যাণে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে। এভাবে জীবকে শিব জ্ঞানে ভালোবাসার দেবোপম উপলব্ধি স্বামী নারায়ন পুরী মহারাজ সবার মাঝে ছাড়িয়ে দিয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত অদ্বৈত-অচ্যুত মিশনের মাধ্যমে। মানব হিতৈষী বহুমুখী কর্মকান্ডের মাধ্যমে স্বামীজী বেঁচে থাকবেন চিরকাল প্রতি মানুষের হৃদয়ে। জনস্মৃতিতে তাঁর মহান অবদান ঝিনুকের বুকে মুক্তোর মতো সঞ্চিত আছে, সঞ্চিতই থাকবে। বিন্দুমাত্র ব্যর্থতা এ ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের জীবনকে স্পর্শ করতে পারেনি। ১৯৮৩ সালে স্বামীজী তুলসীধামের মোহন্ত পদে অভিষেক হওয়ার পর এই ধামকে চট্টগ্রামের একটি নান্দনিক তপোবনে পরিণত করেছেন। প্রায় ৩২ বছর এ মহান ঋষি গুরু পরমপরায় দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে। জীবনব্যাপী তিনি সং ছেড়ে সারকে ধরার নিরলস সাধনা করেছিলেন বলেই মৃত্যুকে তিনি করতে পেরেছিলেন তাঁর ইচ্ছাহীন।
২০১৫ সালের দোলযাত্রার মাহেন্দ্রক্ষণে ভক্ত-স্বজনদের সাথে আলাপ-আলোচনা শেষে স্বামীজী বসলেন যোগাসনে। তখন সন্ধ্যা আরতীর পবিত্র ধ্বনিতে তুলসীধামের আকাশ-বাতাস মুখরিত। ওঁকার উচ্চারণে ব্রহ্মলীন হলেন স্বামীজী। তাঁর মতো দেশমাতৃকার মহান সাধক, কালজয়ী প্রতিভা সমাজে খুব একটা বেশি মিলবে না। কারণ তিনি ভূমিতে দাঁড়িয়ে ভূমাকে স্পর্শ করতে পেরেছিলেন। এ মৃত্যুঞ্জয় মহাপুরুষের অবদান সত্যিই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে প্রতি ভক্তের হৃদয়ে। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের অন্তরে মন্দিরে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। তাইতো সকলের মতো আমারও বিনম্র প্রার্থনা:
‘উদিত তপন অকৃপণ করে যেমনি বিলায় আলো,
তেমনি তুমিও উদার করুণা সবার উপরে ঢালো।’
জয়তু স্বামীজী।
লেখক : বিশিষ্ট ধর্মীয় বক্তা ও প্রধান শিক্ষক