মানবিক ভালোবাসাই হোক চিরন্তন বন্ধন

1

সাইফ চৌধুরী

মানবজীবনের মূল শক্তি হলো ভালোবাসা। ভালোবাসাই মানুষকে মানুষ করে তোলে, তাকে সহানুভূতিশীল, সহমর্মী ও উদার করে। কিন্তু অনেকেই ভুলে যায়, অন্যকে ভালোবাসার আগে নিজের প্রতি ভালোবাসা থাকা জরুরি। যে মানুষ নিজেকে ভালোবাসে, নিজের আত্মমর্যাদা বোঝে, নিজের অস্তিত্বকে মূল্য দেয়, সেই মানুষই প্রকৃত অর্থে অন্যকে ভালোবাসতে পারে। কারণ আত্মপ্রেমের মধ্যেই নিহিত আছে মানবপ্রেমের মূলবীজ। আর এই ভালোবাসা থেকেই গড়ে ওঠে চিরন্তন মানবিক বন্ধন, যা সমাজকে করে তোলে সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও সহাবস্থানের উপযুক্ত।
নিজেকে ভালোবাসা মানে আত্মমর্যাদা রক্ষা করা নিজেকে ভালোবাসা মানে আত্মকেন্দ্রিক হওয়া নয়; বরং নিজের অস্তিত্ব, ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতাকে বুঝে নিজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। যারা নিজের প্রতি সম্মান দেখায়, তারা অন্যের প্রতিও সম্মান দেখাতে জানে। নিজের মনের যতœ নেওয়া, নিজের ভুলকে ক্ষমা করা, নিজের লক্ষ্যকে গুরুত্ব দেওয়া- এসবই আত্মপ্রেমের প্রকাশ। যেমন একজন শিক্ষক যদি নিজের পেশাকে ভালোবাসে, নিজের কাজের প্রতি আন্তরিক থাকে, তবে সে শুধু নিজের উন্নতিই ঘটায় না, তার শিক্ষার্থীদের মাঝেও ইতিবাচকতা ছড়ায়। আবার একজন চিকিৎসক যদি নিজের জীবন ও মানবসেবার প্রতি ভালোবাসা রাখে, সে রোগীর প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হয়। অর্থাৎ নিজের প্রতি ভালোবাসা থেকেই জন্ম নেয় দায়িত্ববোধ, যা মানবতার মূলে অবস্থান করে।

মানবতাকে ভালোবাসা মানে একটি সভ্য সমাজের ভিত্তি : মানবতা হলো মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, সহানুভূতি ও শ্রদ্ধার অন্য নাম। একটি সত্যিকারের সভ্য সমাজ গড়ে ওঠে তখনই, যখন মানুষ একে অপরের প্রতি মানবিক আচরণ প্রদর্শন করে। কেবল আইন, প্রযুক্তি বা ধনসম্পদ কোনো সমাজকে সভ্য করতে পারে না—প্রয়োজন মানবতার আলো, যা হৃদয়ের গভীর থেকে উদ্ভাসিত হয়। মানবতাকে ভালোবাসা মানে নিজের স্বার্থের বাইরে গিয়ে অন্যের কষ্ট বোঝা, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, দুর্বলকে রক্ষা করা এবং অন্যের মর্যাদাকে সম্মান করা। সমাজে যখন মানুষ একে অপরকে বুঝতে শেখে, তখন বৈষম্য, ঘৃণা ও হিংসা কমে আসে। শান্তি ও সৌহার্দ্য তখন সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। আজকের পৃথিবীতে প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক না কেন, মানবতার অভাব সমাজকে অমানবিক করে তুলছে। তাই দরকার ভালোবাসা ও সহমর্মিতার চর্চা,পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত। মানবিক মূল্যবোধ যদি শিক্ষা, নীতি ও আচরণের মূলভিত্তি হয়, তবে সমাজে ন্যায়, শান্তি ও অগ্রগতি নিশ্চিত হবে। অতএব, মানবতাকে ভালোবাসা শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি একটি সভ্য সমাজের মজবুত ভিত্তি। মানুষ যদি মানুষকে ভালোবাসে, তবে পৃথিবী হবে বসবাসযোগ্য, আর সমাজ হবে সত্যিকার অর্থে মানবিক ও সভ্য।

আত্মপ্রেম ও মানবপ্রেমের সম্পর্ক : মানবিকতা শেখানো যায় না। এটি গড়ে ওঠে নিজের ভেতরের ভালোবাসা থেকে। যখন একজন মানুষ নিজেকে ভালোবাসে, সে নিজের সুখ-দুঃখের সঙ্গে অন্যের অনুভূতিও বোঝে। কারণ নিজের যন্ত্রণাকে বুঝতে পারলে, অন্যের কষ্টও অনুভব করা যায়।
ধরা যাক, একজন কর্মজীবী মানুষ, যিনি প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন, নিজের পরিবারের যত্ন নেন, আবার সমাজে অন্যদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেন—এই ভারসাম্য রক্ষা করতে তার নিজের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা থাকা জরুরি। সে জানে, নিজেকে যতœ না নিলে অন্যের প্রতি যত্ন নেওয়া সম্ভব নয়। এই উপলব্ধিই তাকে মানবিক করে তোলে। আত্মপ্রেম নিজের প্রতি ভালোবাসা, আর মানবপ্রেম সেই ভালোবাসার সামাজিক প্রকাশ। একে অপরের পরিপূরক- নিজেকে ভালোবাসলেই সত্যিকারের অন্যকে ভালোবাসা সম্ভব।

মানবিক বন্ধনের চিরন্তনতা : মানবিক সম্পর্কের সৌন্দর্য হলো- এগুলো সময়, জাতি বা অর্থের সীমা মানে না। যে ভালোবাসা আত্মা থেকে আসে, সেটিই দীর্ঘস্থায়ী হয়। চিরন্তন মানবিক বন্ধন গড়ে ওঠে তখনই, যখন মানুষের মধ্যে থাকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ। আজকের দ্রæতগতির পৃথিবীতে মানুষ নিজের স্বার্থ, প্রতিযোগিতা আর সামাজিক মর্যাদার পেছনে ছুটছে। কিন্তু এই দৌড়ে আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। মানবিক সম্পর্কই জীবনের আসল সৌন্দর্য। আমরা যখন কারো পাশে দাঁড়াই, কারো কষ্ট লাঘব করি, তখনই আমাদের জীবন অর্থবহ হয়ে ওঠে। এই নীরব ভালোবাসা ও সহমর্মিতাই আমাদের মধ্যে স্থায়ী বন্ধন তৈরি করে—যা টাকার বা পদমর্যাদার দ্বারা মাপা যায় না।

বাস্তব জীবনের প্রতিফলন : বাস্তব জীবনের দিকে একটু তাকাই। সমাজে আমরা দেখি- কেউ অসহায় মানুষের জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প চালু করে, কেউ পথশিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে, কেউ আবার বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধদের পাশে দাঁড়ায়। এরা সবাই নিজেদের প্রতি সম্মান রেখেই মানবতার সেবায় এগিয়ে আসে। তারা জানে, নিজের জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুললে অন্যের জীবনেও আলো ছড়ানো সম্ভব।
অন্যদিকে, যারা নিজেদের প্রতি উদাসীন, নিজের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে, তারা প্রায়ই সমাজে হতাশা ও বিরূপতা ছড়ায়। নিজের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা মানুষকে অন্যের জীবনের প্রতিও উদাসীন করে তোলে। তাই আত্মপ্রেমের অভাব মানেই মানবতার অভাব।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে মানবিক ভালোবাসার গুরুত্ব : বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, কিন্তু একই সঙ্গে মানুষকে কিছুটা বিচ্ছিন্নও করেছে। ভার্চুয়াল যোগাযোগ বাস্তব সংযোগকে কমিয়ে দিচ্ছে। এমন সময়ে মানবিক সম্পর্ক ও সহানুভূতির চর্চা আরও জরুরি হয়ে পড়েছে। যখন একজন মানুষ নিজের প্রতি দায়িত্বশীল থাকে, নিজের মানসিক ও সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখে, তখনই সে প্রযুক্তি ও সমাজের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারে। এভাবেই আত্মপ্রেম মানবপ্রেমে রূপ নেয় এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।

নিজেকে ভালোবাসা মানে মানবতার চর্চার সূচনা : নিজেকে ভালোবাসা শুরু হয় ছোট ছোট কাজ থেকে। নিজের প্রতি সততা বজায় রাখা, নিজের ভুল স্বীকার করা, নিজের যত্ন নেওয়া, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। যেমন, অফিসে একজন কর্মী যদি নিজের কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করে, সহকর্মীদের সাহায্য করে এবং নিজেকে উন্নত করতে সচেষ্ট থাকে, তাহলে সে নিজের ও সমাজের জন্যই ইতিবাচক অবদান রাখছে। এইভাবে আত্মপ্রেম থেকে মানবপ্রেম জন্ম নেয়, আর মানবপ্রেম থেকেই চিরন্তন মানবিক বন্ধনের সৃষ্টি হয়। যে নিজেকে ভালোবাসে, মানবতাকে ভালোবাসে, তারই সঙ্গেই থাকে চিরন্তন মানবিক বন্ধন- এই কথাটি শুধু একটি উক্তি নয়, এটি এক অনন্ত সত্য। নিজের প্রতি ভালোবাসা মানুষকে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলে, আর এই ভালোবাসাই সমাজে সৌহার্দ্য, সহানুভূতি ও শান্তির বীজ বপন করে। আমরা যদি নিজেদের প্রতি ভালোবাসা রাখি, নিজেদের মানসিক শক্তিকে লালন করি, তাহলে আমরা সহজেই অন্যের দুঃখ বুঝতে পারব, অন্যের জন্য কাজ করতে পারব, এবং একটি মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারব। কারণ চিরন্তন মানবিক বন্ধন কোনো চুক্তি নয়, এটি এক অব্যক্ত অনুভূতি- যা জন্ম নেয় ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির মধ্য দিয়ে। সুতরাং, নিজের প্রতি ভালোবাসা এবং মানবতার প্রতি সচেতনতা একই সাথে চলে। একজন মানুষ নিজের জীবনকে যত্নশীলভাবে গড়ে তুললে, সে অন্যের জীবনেও আনন্দ ও সহানুভূতি ছড়াতে পারে। নিজেকে ভালোবাসা মানে মানবিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করা। মানুষের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয় তখনই, যখন সে নিজের প্রতি সতর্ক থাকে এবং নিজের জীবনকে বোঝে। এভাবেই চিরন্তন মানবিক বন্ধন তৈরি হয়।
নিজেকে ভালোবাসা মানে আত্মমুগ্ধতা নয়, বরং মানবতার প্রতি সচেতনতা। যে মানুষ নিজের ভেতরে শান্তি ও শ্রদ্ধা খুঁজে পায়, সে অন্যের জীবনেও আলো ছড়াতে পারে। নিজেকে ভালোবাসা মানেই পৃথিবীকে একটু বেশি ভালোবাসা, মানুষকে একটু বেশি বোঝা, আর সম্পর্কগুলোকে আরও মানবিক করে তোলা। আমাদের জীবনের এক গভীর বাস্তবতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রতিটি মানুষের জীবন একটি নাটকের মতো, যেখানে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করি। কখনো আমরা সন্তান, কখনো বন্ধু, কখনো সহকর্মী, আবার কখনো বাবা-মা বা সঙ্গী হিসেবে জীবনের বিভিন্ন মঞ্চে উপস্থিত থাকি। কিন্তু এই জীবনের মঞ্চের চূড়ান্ত দৃৃশ্য, অর্থাৎ মৃত্যুর সময়, সেটি সকলের জন্য একক এবং একা। এটি আমাদের শেখায় যে, যতটা পরিবার, বন্ধু বা সমাজ আমাদের সাথে থাকুক, জীবনের শেষ মুহূর্তে আমাদের নিজস্ব আত্মার সঙ্গে নিঃসঙ্গ থাকার বিষয়টি চরম সত্য। সুতরাং, জীবনকে সুন্দর আর সমাজকে মানবিক করতে চাইলে, প্রথমেই নিজেকে ভালোবাসতে জানতে হবে। নিজের প্রতি হতে হবে যত্নশীল ও দায়িত্ববান। কারণ, যে নিজেকে ভালোবাসতে শেখে, সে-ই অন্যকে সম্মান, সহমর্মিতা এবং সহযোগিতার হাত বাড়াতে জানে। আর সেই মনুষ্যত্বপূর্ণ হৃদয়েই জাগে সত্যিকারের মানবতার আলো।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক