মানবাধিকার সুরক্ষায় আন্তরিক হতে হবে

1

আজ শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার বিষয়টি আপেক্ষিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ শব্দটির ব্যাপকতাকে সীমিত করা হয়েছে। কাগুজে মানাবাধিকারের কথা লেখা থাকলেও বাস্তবে খুব একটা দৃশ্যমান নয়। আজ ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের সদস্যভূক্ত প্রতিটি দেশে আজ ব্যাপক উৎসাহ উদ্দিপনায় পালন করা হবে আজকের এ দিনটি। কিন্তু মানুষের অধিকার নিয়ে যখন আজ দিনটি সরব থাকবে, গর্জে উঠবে লাখো কণ্ঠ, তখনও ফিলিস্তিনের গাজা লাশের স্তূপে ভরে উঠবে। বাতাসে রক্তের গন্ধ ভাসবে। কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো নির্বিকার। একই অবস্থা লেবানন, সিরিয়া, ইয়ামেন, ইউক্রেন, সুদানসহ বিশ্বের বহুদেশে। বাংলাধেসহ অনেক উন্নয়ন ও স্বল্প উন্নত দেশেও গণতন্ত্রের আবরণে চলে মানবাধিকার লঙ্গনের উৎসব। ধর্মে, ধর্মে, সম্প্রদায়, সপ্রদায়ে হানাহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ আজকাল নিত্য বিষয়ে পরিনত হয়েছে। সংখ্যা লঘুর উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদ নীতি বিশ্বব্যাপী সম্প্রীতির বন্ধনকে নড়বড় করে তুলছে।কিন্তু দিবসে উজ্জ্বল্য থাকলেও মানবের অধিকার যেন অন্ধকার কূপে নির্বাসনে যাচ্ছে। এ অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি।
আমরা জানি, বিশ্বের মানুষের জীবন, অধিকার, সমতা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সুযোগ সুবিধাগুলোই মানবাধিকার। মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গ্রহণ করা হয়। সেখানে মানুষের মৌলিক মানবাধিকারগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এজন্য ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ অনুযায়ী, মানবাধিকার অর্থ- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান দ্বারা নিশ্চিত কোন ব্যক্তির জীবন, অধিকার, সমতা ও মর্যাদা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত এবং বাংলাদেশের প্রচলিত আদালত দ্বারা বলবৎযোগ্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলে ঘোষিত মানবাধিকার। মানবাধিকারের মূলনীতিসমূহ হলো সাম্য, মানবিক, মর্যাদা,সামাজিক ন্যায়বিচার। আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত মানবাধিকারের মূলনীতিগুলোকে বাংলাদেশ সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং নাগরিকের মানবাধিকারের সুরক্ষায় বিভিন্ন বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, বিশ্রাম ও চিত্ত বিনোদন এবং সামাজিক নিরাপত্তার মতো অর্থনৈতিক ও সামাজিক মানবাধিকারসমূহ এবং নাগরিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সুরক্ষার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মানবাধিকার রক্ষা এবং তার উন্নয়নের প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তার প্রশাসন, বিচার ও আইন বিভাগের মাধ্যমে জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করবে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদানের জন্য জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান গঠন করে। বাংলাদেশ এর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। জাতীয় মানাবাধিকার কমিশন বাংলাদেশেও রয়েছে। বাংলাদেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন-২০০৯ দ্বারা ২০১০ সালের জুন মাসে একজন চেয়ারম্যান, একজন সার্বক্ষণিক সদস্য এবং পাঁচজন অবৈতনিক সদস্যের সমন্বয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়। বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এখতিয়ার যথেষ্ট বিস্তৃত। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিসমূহ বাংলাদেশ যার পক্ষভুক্ত, ইত্যাদি দলিলপত্রে এই এখতিয়ার সংরক্ষিত। মনে রাখতে হবে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে যে অধিকারগুলো সকল নাগরিককে দেওয়া হয়েছে, তার লঙ্ঘন হলে বা লঙ্ঘনের আশঙ্কা তৈরি হলে বা স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে বর্ণিত অধিকারসমূহ লঙ্ঘিত হলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ করা যায়। কেউ যদি মনে করেন যে, মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে তাঁর জীবন, সমতা ও মর্যাদার যে অধিকার পাওনা আছে তা ক্ষুণ্ণ হয়েছে কিংবা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন বা কোনো জনসেবক বা কোনো ব্যক্তি কর্তৃক মানবাধিকার (জীবন, অধিকার, সমতা ও মর্যাদা সংক্রান্ত অধিকার) লঙ্ঘন করা হয়েছে বা লঙ্ঘনের প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে বা এইসব অধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে অবহেলা করা হয়েছে, তাহলে মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ করা যায়।
আর অভিযোগ কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে হলে কমিশন অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে, তদন্তে যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় প্রকাশ পায়, তাহলে কমিশন অভিযোগকারী এবং অভিযুক্তের মধ্যে উদ্ভূত বিরোধটি মধ্যস্থতা ও সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে, মধ্যস্থতা সফল না হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা বা অন্য কোনো কার্যধারা দায়ের করার জন্য কমিশন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করবে। কমিশনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেন তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে নাগরিকের মর্যাদা, সম্মান, সমতা ইত্যাদির অধিকার লঙ্ঘন করতে না পারে তার প্রতি লক্ষ্য রেখে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা। তবে মানবাধিকার কমিশনের সাংবিধানিক যে এখতিয়ার ও অধিকার তা কখনো যথাযথভাবে প্রয়োগ করছেন বলে আমাদেও মনে হয় না। এক্ষেত্রে কমিশনকে আন্তরিক হতে হবে, অবশ্যই সরকারের সহযোগিতা জরুরি। এছাড়া মানবাধিকারের বিষয়ে জনসচেতনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা মনে করি, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশকে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত করার মধ্য দিয়ে নাগরিকের মর্যাদা, সম্মান, সমতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।