মাদক নির্মূলে ডোপ টেস্ট নেতিবাচক বিষয় নয়

7

সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার চৌধুরী

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ডোপ টেষ্ট বাধ্যতামূলক এই ঘোষনাটি কারো কাছে ইতিবাচক আবার কারো কাছে নেতিবাচক হিসেবে মনে হবে, কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি ইতিবাচক।
ডোপ টেস্ট কি- আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট শব্দটির সাথে অনেকেই পরিচিত। এই ডোপ টেষ্টে পজেটিভ হওয়ার কারনে অনেক পৃথিবীর বিখ্যাত খেলোয়াড় নিষিদ্ধ হয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কিংবদন্তী ফুটবল খেলোয়াড় দিয়াগো ম্যারাডোনা। কোন ব্যক্তি মাদকাসক্ত কিনা তা যাচাইয়ের জন্য যে মেডিকেল টেস্ট করা হয় তার নাম হচ্ছে ডোপ টেস্ট। যারা নিয়মিত মাদক সেবন করেন তাদের শরীরে একটা সময় পর্যন্ত ঐ নেশা জাতীয় পদার্থের অস্তিত্ব থেকে যায়। মাদকাসক্ত ব্যক্তির লালা, মূত্র, রক্ত এবং চুলের পরীক্ষার মাধ্যমে মাদকের নমুনা সংগ্রহ করে মাদকাসক্ত কিনা তা সনাক্ত করা হয়। বাংলাদেশের মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এর প্রনীত খসড়া অনুযায়ী ডোপ টেস্টে নির্দিষ্ট কিছু মাদক পরীক্ষা করা হয় যার মধ্যে রয়েছে- ডায়াজেপাম, লোরাজেপাম, অক্সাজেপাম, টেপাজেপাম, কোডিন, মরফিন, হেরোইন, কোকেন , গাজা, ভাং, চরস, এলকোহল বা মদ, ফেন্সিডিল, ইয়াবা ও এলএসডি ।
বাংলাদেশে প্রকৃত মাদকাসক্তের সংখ্যা নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ৭৫ লক্ষাধিক, বেসরকারী হিসেবে তা প্রায় ১ কোটি। আমাদের দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সের মানুষের হার বেশী, যার হার ৭০ ভাগ। ১৮ থেকে ৩০ বছরের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে মাদক গ্রহণের হার ভয়াবহ। প্রতি বছর এই মাদকের পেছনে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে। মাদকাসক্তি আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গন তথা স্কুল, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যেভাবে বিস্তার লাভ করছে এখনই তার লাঘাম টেনে ধরতে না পারলে ভবিষ্যতে তা নিবারণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশে শিক্ষিত মাদকাসক্ত যে যুব সমাজ রয়েছে তাদের পরিবারের অনেকেই জানে না যে তাদের সন্তান মাদকাসক্ত। কারন বর্তমান সময়ে যে মাদক সমূহের বিস্তার রয়েছে তাদের মধ্যে অনেক গুলো মাদক গন্ধবিহীন হওয়ায় অনেকের পরিবারই বুঝতে পারে না যে তাদের সন্তান মাদকাসক্ত। যখন টের পায় তখন হয়তো তাদের ফেরানোর পথ থাকে না। একটি দেশের যুবসমাজ হচ্ছে মূল মানবসম্পদ। শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর অনেক দেশের যুবসমাজের বিরাট একটি অংশ মাদকের করালগ্রাসে নিমজ্জিত, বাংলাদেশে নানা কারণে তার সংখ্যা দ্রæত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের তরুণ সমাজ মাদকের ভয়াবহ প্রভাবে বিপদগামী হচ্ছে। মাদকের নীল ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের আগামী প্রজন্ম। দেখা যায়, যে সন্তান পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করতে পারতো, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত করে, মেধা ও মনন দিয়ে দেশের গর্বে পরিণত হতে পারতো, সেই সন্তান আজ মাদকের স্পর্শে, মাদকের করালগ্রাসে কেবল ধ্বংসই হচ্ছে না, ধ্বংস করে দিচ্ছে একটি পরিবারের কাঙ্ক্ষিত সুখের স্বপ্ন।
যুবসমাজ যেহেতু একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। সুতরাং এই যুবসমাজকে যে দেশ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে সে দেশ তত দ্রæত উন্নতি লাভ করবে। ২০৪১ সালের বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ করার সরকার যে লক্ষ্য স্থির করেছে তা পূর্ণতা পেতে হলে আমাদের শিক্ষিত যুবসমাজকে যথার্থভাবে ব্যবহার করতে হবে। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রতিযোগিতায় বিশ্বের সকল দেশের মানবসম্পদ বিভিন্নভাবে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ন হচ্ছে এবং সেই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে হলে আমাদের অবশ্যই দক্ষ ও শিক্ষিত মানবসম্পদ প্রয়োজন। কিন্তু এই শিক্ষিত যুব সমাজ বা মানব সম্পদের একটি বৃহৎ অংশ কোন না কোনভাবে বিভিন্ন কারনে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে এবং তাদের সাহচর্যে দিন দিন মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি তাদের অনেকেই আবার মাদক বেচাকেনা বা পাচারের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ছে। মাদকের ক্রমবর্ধমান এই বিকাশকে রোধ করতে হলে আমাদের মাদক বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মাদকাসক্ত হওয়ার সুযোগ বা পথগুলো বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের মাদক সেবন, বিক্রি বা পাচারের বিরুদ্ধে যে আইন রয়েছে তার সঠিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার ফলে তার কার্যকারিতা সমাজে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারছে না, সাক্ষী প্রমানের অভাবে অনেক অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনা যায় না। তাই প্রকৃত মাদক সেবী চিহ্নিত করনে প্রয়োজন আধুনিক ব্যবস্থা যাকে বলা হয় ডোপ টেষ্ট।
আমাদের যুব সমাজ তথা বাংলাদেশকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা উচিৎ। আমরা দেখেছি করোনা অতিমারীর বিস্তার রোধে পৃথিবীর সকল দেশে করোনার প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, টিকা গ্রহণের সার্টিফিকেট সংযুক্ত না থাকলে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত ছিল। যার ফলে মানুষের কাছে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে তাতে দ্রæত করোনা বিস্তার রোধ হয়েছে এবং পৃথিবী একটি মারাত্মক মহামারী এবং জীবনক্ষয় থেকে রক্ষা পেয়েছে। পৃথিবীব্যাপী এই মহামারী বা অতিমারী এখনো বিদ্যমান হলেও টিকা বা প্রতিষেধক গ্রহণের কারণে তার বিস্তার হ্রাস পেয়েছে। তেমনিভাবে বাংলাদেশে ২০ থেকে ৪০ বছরের ব্যক্তিদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডোপ টেষ্ট করা বাধ্যতামূলক করা হলে মাদকের বিস্তার রোধ হবে এবং আমাদের সমাজ ও দেশ রক্ষা পাবে।
একটি দেশের উন্নয়নে মূল শক্তি যেমন যুব সমাজ, তেমনি মাদক হচ্ছে একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার মোক্ষম অস্ত্র। আমাদের স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এই মাদকের নীল ছোবলে দংশিত আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম, আমাদের সকলের দায়িত্ব এই তরুণ প্রজন্মকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করা। তাই সকলের জন্য একটু ব্যয়বহুল হলেও সরকারের উচিৎ উচ্চশিক্ষা গ্রহণে এবং চাকুরীক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা, হউক সেটি সরকারী, বেসরকারী বা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই হউক না কেন সেই নিরিখে অত্যন্ত আশার কথা হচ্ছে উচ্চশিক্ষা গ্রহনে ভর্তির ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করেছে। শুধু সরকারী চাকুরী বা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ক্ষেত্রে নয় প্রাইমারী থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীর অভিভাবকদেরও ডোপ টেষ্ট করা প্রয়োজন। কারণ শুধু শিক্ষার্থী নয় অনেক অভিভাবকও বিভিন্নভাবে মাদকাসক্ত।
আমরা জানি স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে শুরু করে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলেও অবশ্যই তাদের আয়কর সার্টিফিকেট, ঋণখেলাপী নয় এই মর্মে ব্যাংক সার্টিফিকেট নির্বাচন কমিশনে প্রদান করা বাধ্যতামূলক, এর পাশাপাশি নির্বাচনে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করা হলে ক্রমান্বয়ে এদেশে মাদকের বিস্তার রোধ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এছাড়া শুধু ভর্তি বা চাকুরীর ক্ষেত্রে একবার ডোপ টেস্ট নয় বরং মাদক বিস্তার রোধে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতি বছর ডোপ টেস্ট করা উচিৎ।
ডোপ টেষ্ট এই বিষয়টিকে আমাদের অনেকেই নেতিবাচক বা ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন, যার ফলে ইতোমধ্যে কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন, এর প্রতিবাদও জানিয়েছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন তাহলে কেন শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এই নিয়ম-আমি বলবো, হয়তো এখান থেকেই শুরু হবে মাদক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার নতুন যাত্রা। সমাজ এবং রাষ্ট্রকে বাঁচাতে হলে আমাদের সকলকে তো একটি সেক্রিফাইস করতেই হবে তাই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট করার বিষয়টি স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দৃষ্টিকটু বা নেতিবাচক মনে হলেও এই ডোপ টেস্ট একদিন হয়তো বাংলাদেশকে মাদকমুক্ত করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে শুধু ডোপ টেস্টকে মাদক মুক্ত করার অনুষঙ্গ ভাবলে হবে না, মাদকাসক্তি প্রতিরোধে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সমাজের সকল ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার-
বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ