মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা

1

মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী

মাদকদ্রব্য বলতে এমন সব পদার্থকে বোঝায় যা শরীরে প্রবেশ করার পর স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যকারিতাকে পরিবর্তন করে এবং যা সেবনের ফলে মানসিক ও শারীরিক নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে। এই পদার্থগুলি মানবদেহের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, এমনকি অকাল মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, ‘মাদকদ্রব্য সেবনের ফলে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং এটি সমাজের জন্য একটি বড় সমস্যা। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক ও শ্বাসযন্ত্রের কার্যক্ষমতা দিন দিন কমতে থাকে। এসব জীবন বিধ্বংসী ক্ষতিকারক দ্রব্য সেবনের ফলে যুবসমাজের সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটছে। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধ করার পাশাপাশি মাদকদ্রব্যের কুফল সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস ২৬ জুন পালিত হয়। এই দিবসটি বিশ্বজুড়ে মাদকাসক্তি ও অবৈধ মাদক পাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি এবং এই সমস্যাগুলির সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষও বটে। পাশাপাশি মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার এবং অবৈধ মাদক পাচারের বিরুদ্ধে এটি একটি বৈশ্বিক পদক্ষেপের অংশ। যাতে বিশ্বব্যাপী মানুষ মাদকাসক্তির বিপদ সম্পর্কে জানতে পারে এবং এর প্রতিরোধে সচেতন হয়।সারা বিশ্বে তরুণ প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলোর মধ্যে মাদকাসক্তিই সবার শীর্ষে। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। মরণব্যাধি মাদকাসক্তি ক্রমশ ভয়াবহ রূপ ধারণ করার পাশাপাশি মাদকের ব্যবহারও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ধারনা করা হয়ে থাকে, নিষিদ্ধ জগতের অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। বর্তমানে দেশের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মাদকের কেনাবেচা হয় না। শহর থেকে শুরু করে গ্রামেও এটি সহজলভ্য। এক সূত্র থেকে জানা যায়, ‘আমাদের দেশে প্রচলিত মাদকদ্রব্যের মধ্যে ইয়াবা, গাজা, ফেনসিডিল, মদ, আফিম, হেরোইন, কোকেন, প্যাথেডিন, বিভিন্ন ধরনের ঘুমের ওষুধ, এমনকি জুতার আঠাও রয়েছে। এসব ভয়ানক নেশা জাতীয় দ্রব্য সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে। এসব মাদকের বেশির ভাগই আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার হতে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে। মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কেননা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে শত শত নদ-নদী দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। মাদক চোরাকারবারিরা সমুদ্র উপকূল ও জলপথকে তাদের পণ্য পাচারের খুবই উপযুক্ত পথ বা রুট হিসেবে বিবেচনা করেন। চিকিৎসকদের মতে, বহুমাত্রিক কারণে দেশের যুব সমাজের একটি বিরাট অংশ মাদকের করালগ্রাসে নিমজ্জিত। মাদক সেবনের ফলে মানুষের মাঝে এক ধরনের ভালো লাগা তৈরি হয়। সাময়িক শক্তি, আত্মবিশ্বাস, সাহস বাড়িয়ে দিতে পারে কোকেনের মতো মাদক। হেরোইনের প্রভাবে প্রশান্তি আর তৃপ্তির অনুভূতি জন্মায়। ডিপ্রেশন, মানসিক চাপ, বিষন্নতা ইত্যাদি কমাতেও মাদক সাময়িক সময়ের জন্য কাজে দেয়। মাদকাসক্তের বড় অংশ মানসিক চাপে পড়ে মাদক গ্রহণ শুরু করে। আর এভাবেই হাজার হাজার কিশোর কিশোরী সহ নানা বয়সের মানুষ আটকে পরে মাদকের দূর্ভেদ্য জালে। কিছু কিছু মাদক মনোসংযোগ ঠিক রাখতে সাহায্য করে। স্কুল কলেজের ছাত্ররা এসব মাদক গ্রহণ করে তবে মাদক নিতে নিতে এক সময় দেখা যায় তারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। কৈশোরকালে মাদকাস্কতি ছড়ায় সবচেয়ে বেশি পরিমাণে। এই সময়টা জীবনের একটা উত্তরকালীন পর্যায়, এই সময়ে মনের মধ্যে নানারকম দুশ্চিন্তা ও হতাশা বাসা বাধে। এ সময় বন্ধু বান্ধবের চাপে ও প্রলভনে পড়ে অনেকে মাদক নেওয়া শুরু করে। মাদক প্রথম প্রথম খুব একটা আসক্তি তৈরি করে না। বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে সক্ষম হবে এই বিশ্বাসে মাদক নেয়। আর নিজের অজান্তেই মাদকের ওপর তাদের নির্ভশীলতা তৈরী হয়। এক তথ্য থেকে জানা যায়, দিনদিন যুবসমাজের মাদকের প্রতি আসক্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি। যেখানে প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে শিশুকিশোর ও তরুণ-তরুণী। বিশাল সংখ্যক মাদকাসক্তের মধ্যে আবার প্রায় ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ শিশু-কিশোর সঙ্গদোষ ও বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে, ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ কৌতূহলবশত হয়ে মাদক সেবনের মাধ্যমে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। মাদকসেবীদের অজান্তেই মাদক সেবনে তাদের শারীরিক ও মানসিক উভয়প্রকার ক্ষতিসাধন হয়। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক ও শ্বাসযন্ত্রের কার্যক্ষমতা দিন দিন কমতে থাকে। এসব জীবন বিধ্বংসী ক্ষতিকারক দ্রব্য সেবনের ফলে যুবসমাজের সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটছে। এরই পরিণাম স্বরূপ ছেলেমেয়ের হাতে মা-বাবা খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, রাহাজানি, ধর্ষণ, যৌন-নিপীড়ন, এখনকার নৈমিত্তিক ঘটনা। এক তথ্য থেকে জানা যায়, মাদকাসক্ত হওয়ার প্রধান কারণ হলো মাদকের সহজলভ্যতা। এ ছাড়াও পারিবারিক কলহ, বেকারত্ব,প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির অসামঞ্জস্যতা, হতাশা ইত্যাদি কারণেও যুবসমাজ মাদকের প্রতি আসক্ত হচ্ছে। স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও মাদক পৌঁছে গেছে। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ও শৈশব থেকে তাদের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে। কিন্তু শঙ্কার বিষয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোকে আজকে মাদক গ্রাস করে ফেলেছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চললেও অভিযান চালানো হয় না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিরাপদে মাদক গ্রহণের আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিণত হচ্ছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষনার মাধ্যমে প্রাপ্ত বেশকিছু পদ্ধতি মাদক মুক্ত জীবন যাপনে সাহায্য করতে পারে। তবে অন্যান্য জীবাণু ঘটিত রোগের মত মাদকের কারণে সৃষ্ট ডিসওর্ডার নিরাময় করা যায় না। একটু অসতর্ক হলেই আবার রোগী মাদকাসক্ত হয়ে যেতে পারে। সাধারণত ডাক্তারের পরামর্শ মেনে না চললে আবার মাদকাসক্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। মাদকের চিকিৎসা মূলত ২ ধাপে হয়।
১। প্রথমবার মাদক ছাড়ার পর রোগীর শারীরিক মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটে। রোগী প্রায় সময় ডিপ্রেশনে চলে যায়, ঘুমাতে না পারা, উচ্চ রক্ত চাপ, দুশ্চিন্তা করা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসক প্রথমে এসব উপসর্গের চিকিৎসা করেন। রোগী বারবার মাদক গ্রহনে বাধ্য হলে সাইকোথেরাপি বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
২। বার বার মাদকের কাছে ফিরে যাওয়া রোগীদের জন্য বিশেষ থেরাপির ব্যবস্থা করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে ঔষধের সাহায্য নেওয়া হয়। আফিমজাতীয় মাদক বা অফিওয়েড থেকে মুক্তির জন্য মেথাডোন, বিউপ্রেনরপাইন, নাল্ট্রেক্সোন, লোফেক্সিডিন, তামাক জাতীয় মাদক বা নিকোটিনের প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য বিউপ্রপিওন, ভারেনিক্লিন জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করা হয়। মাদকের ব্যবহার এখনই না কমালে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভয়াবহ হুমকির মধ্যে পড়বে। বর্তমানে বাংলাদেশে ২৫ লক্ষের বেশি মানুষ নিয়মিত মাদক সেবনের সাথে জড়িত। মাদকের ঝুঁকির মধ্যে আছে এর দ্বিগুণের চেয়েও বেশি মানুষ।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দেওয়া এক তথ্যমতে ২০১৯ সালে প্রতিদিন ১১৪ জন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছিল। যে সংখ্যা ২০১৭ সালে ছিল মাত্র ৬৯।রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং মায়ানমার থেকে ইয়াবা চোরাচালান বাড়ার কারণে এ সংখ্যা দ্রæত বাড়তে শুরু করেছে। দেশের বাজারে ইয়াবার একটি পিল ৩৫০ টাকার বেশি হলেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে পাওয়া যায় ৫০ টাকায়। পুরো ২০১৮ সালে মাত্র ৯১ জন মহিলা সরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নেন। এই সংখ্যা ২০১৯ এর নভেম্বর পর্যন্ত হয় ৩৬০, যা প্রায় ৪ গুণ। বাংলাদেশ মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য ৪ই মে ২০১৮ সালে যুদ্ধ ঘোষনা করে। এর আগে ফিলিপাইনও এমন যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তবে সুইজারল্যান্ড আর পর্তুগালের মত দেশ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মাদকের ব্যবহার কমাতে খুব একটা কার্যকরী নয়। পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা ছাড়া মাদকের নীল দংশন থেকে যুব সমাজকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। মাদকের চোরাচালান রোধ এবং মাদকের সহজলভ্যতা এবং সহজপ্রাপ্যতার দ্বার বন্ধ করা সবার আগে জরুরি। আমাদের দেশে মাদকবহনকারীদের শাস্তি দেয়া হলেও মূলহোতা বা গডফাদাররা থেকে যায় আড়ালে আবডালে। অনেকের ধারনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী এবং অসৎ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার মাধ্যমে এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এ ছাড়াও দেশে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং মাদক চোরাচালানকারীদের কঠিন কঠোরভাবে দৃশ্যমান এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মাদক প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন এনজিও, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম বা অন্যান্য ধর্মের বিশিষ্টজন, পিতামাতা, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। স্ব স্ব ক্ষেত্রে থেকে তাঁরা তাঁদের বক্তব্য ও কর্মের মাধ্যমে জনগণকে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলবেন এটা আমাদের প্রত্যাশা। স্কুল- কলেজে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদকের ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে শিক্ষাদান ও বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা রক্তের দামে কেনা বাংলাদেশের যুব সমাজকে মাদক থেকে দূরে রেখে একটি সুখী সুন্দর সমৃদ্ধশালী বাংলদেশ গড়ে তোলাই হোক মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসের অঙ্গীকার।
লেখক : প্রাবন্ধিক