মাতৃশক্তি ও সনাতনী ঐতিহ্য

1

লায়ন ড. শ্রীরাম আচার্য্য

‘সনাতনীসূত আমার আমরা রাখিব বিশ্বের সম্মান,
মাতৃতন্ত্রে মুক্তির স্বাদ লভিবে বিশ্বপ্রাণ।
আমাদের নারী বরণীয়া তার নারীত্ব গৌরবে,
বিশ্বের মাঝে মহীয়সী নারী আত্মার সৌরভে।
মাতৃসাধক মহাজাতি জাগো, জাগো দুর্জয় প্রাণ-
মহাশক্তির সাধনায় গাও এগিয়ে চলার গান।”
(চরৈবেতিঃ শ্রীমৎ সুধেন্দু বিকাশ)
মাতৃ সাধক, মাতৃপাগল, বিগলিত প্রাণ সাধুভক্তবৃন্দের উদ্যোগ এবার এক নবতর শপথের তীব্রতায় ও সংকল্পের নিষ্ঠায়, প্রাণ পরাগের বিস্তৃত লাবণ্য সুষমায় ও এক বলিষ্ঠ আদর্শের প্রবল উপস্থাপনার জন্য বার্ষিক বা দৈনন্দিন মহাপার্বণী অনুষ্ঠিত হয়। এ এক চারু প্রসাদগর্ভ সন্দেশ। ভীষণ এ প্রশ্ন রাখা হয়েছে। জগতের স্ত্রীজাতি মাহামায়ার অংশসম্ভূতা এবং পূজ্যা। কিন্তু কেন দিকে দিকে “মাতৃজাতির অবমাননা, দুঃসহ দুঃখ লাঞ্ছনা”?
মাতৃমহিমার স্ফুরণ ও বিস্তারের মহান আদর্শকে উজ্জীবক উপাদান রূপে চিহ্নিত করে মাতৃপূজারিবৃন্দ যুগ প্রয়োজনীয় এক মহান পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। জীবনে ও সমাজে মাতৃমহিমাকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে জাতি বাঁচবে না। আত্মজ্ঞানহারা পৃথিবীর একপাল মানুষ ছুটে চলছে অন্ধের মত ভোগলালসা পীড়ার তাড়নায়। পূজার আসন থেকে পূজ্যাকে চ্যুতা করে তাকে পণ্যে রূপান্তরিত করার ঘৃণ্য প্রয়াসে অসুর দল মেতে উঠেছে। এ অবস্থায় পরমামাতা ছাড়া আমরা ব্যক্তি ও সমষ্টিগতভাবে অবলম্বন করার মত কাকে পাবো? শ্রী সদাশিব মাতা অম্বিকাকে বলেছিলেন-
“অহং হবো মহাদেবা মাং সংস্তৌষি চ চাধুনা।
সম্মুখীভব হে কালি সমাশ্বাসয় শংকরি \
(কালিকাপুরাণম্ ৩৪/১০৫)
মহাদেব বললেন, ‘হে দেবি আমি শিব। আমার প্রতি তুমি সন্তুষ্টা হও, আমার দিকে কৃপা করে মুখ ফিরাও আমাকে সাহস দাও।’ ‘সমাশ্বাসয়’- মন্ত্রাংশটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। স্বয়ং শিব যে মহামায়ার কাছে কৃপা চান। সাহস ও আশ্বাস চান, আমরা বর্তমান জগতের মানুষ সেই মাতৃশক্তিকে অবমাননার অন্ধকার অতলে নিমজ্জিত করে কোন প্রগতি এবং উন্নতির পথে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি! আমাদের মানবসভ্যতা এখনও যে টিকে আছে তাও মায়ের অশেষ কৃপার ফল। ‘নারীর নয়নবিন্দু তী² দাবানল। কে বলে অবলা নারী? অন্তরস্থ বল, অহরহ তার মধ্যে রয়েছে ব্যাপিয়া, দুরন্তের মুÐপাত-শপথ কাঁপিয়া। নারী তো বীরবর, এই সত্য জানি।”
মাতৃকৃপা না হলে মাতৃমহিমার স্ফুরণ করাও সম্ভবপর ব্যাপার নয়। ভয়ঙ্কর তমসা শক্তিই মূলতঃ মূর্তিমান অসুর। এই অসুর সত্তাই যুগে যুগে মাতৃশক্তির অবমাননার কারণ হয়েছে; আবার মাতাই (‘অতি সৌম্যাতিরৌদ্যা’- অতি কোমলা ও ভীষণা রুদ্ররূপা) সে তমাকে ধ্বংস করেছেন এবং মানবজাতির সামনে মাতৃশক্তির জয়বার্তা ধ্বনিত করেছেন। পরাজিত মূহ্যমান মহিষাসুর মাতৃকৃপায় দিব্যজ্ঞান ফিরে পেয়ে কৃতকর্মের জন্য ভীষণ অনুতাপ করে বলেছিল-
‘যদি দেবি প্রসন্নাসি যজ্ঞভাগাশ্চ কল্পিতাঃ।
তদা মমান্যদানাশ এবমেতদ্ ভবেন্নহি ”
(কালিকাপুরাণম্ ৬০/১৩০)
‘হে দেবি, যদি আমার উপর প্রসন্ন হয়েছেন এবং আমার জন্য যজ্ঞভাগেরও কল্পনা করেছেন, তবে যেন পুনরায় আমি এরূপ না হই।’ দেবীকে প্রণাম করে মহিষাসুর গদগদস্বরে বললো-
‘যথাহং ন সুরৈং সার্দ্ধং করিষ্যে বৈরামাদ্ভুতম্।
তথামং কুরুভো দেবি ন জন্ম প্রলভে যথা \’
(কালিকাপুরাণম্ ৬০-১৩১)
অসুর আর অসুরের মত আচরণ করতে চাইছে না। ‘ন সুরে ঃ সার্দ্ধং করিষ্যে বৈরম।’ দেবতাদের সাথে আর বৈরিতাও আকাঙ্খা করছে না। তাকে এমন যেন করা হয়- “ন জন্ম প্রলভে যথা।” অসুর জন্ম করার সাধ তার নাই। মাতৃশক্তির মহাউত্থানই তন্ত্রসার, মাতৃসাধকের মধ্যেই মাতা বিরাজিতা, মাতৃগীতির প্রতিটি কলি মহাশক্তিশালী মন্ত্র, প্রদীপক সঞ্জীবক। নারীর ঐতিহ্য সনাতনী সমাজে বিশাল ও সকলের অনুস্মরণীয়। যে মায়ের পায়ের তলায় অসুর লুটায় তাঁর আবার ভয় কোথায়? তাই হে মাতৃজাতির আশিস পুষ্ট সন্তানবৃন্দ শ্রবণ কর। রামচন্দ্রের রক্তবাহিত যাহাদের ধমনীতে- গীতার মন্ত্র রয়েছে যাদের মহাজীবনের ভিতে, যাদের মৈত্রী গার্গেয়ী হলো অমৃত-অনুরাগী, সীতা সাবিত্রী দময়ন্তীর আদর্শ আজো জাগি, সে জাতি কখনো হতে নাহি পারে মাতৃতন্ত্র হারা, সে জাতির নারী হতে পারে নাকো পূত আদর্শ হারা। দেবকী-যশোদা-শচীমা-সারদা দানিল দীক্ষা, সে নারী জাতির পূজায় যজ্ঞে লহ, নতুন শিক্ষা। (আর্যদর্পণ : ১৩৫৪)
আমরা তীর্থদর্শন করি, পূজা-পার্বণ করি, উৎসবাদির আয়োজন করি। কিন্তু গ্রাম গ্রামান্তে তীর্থ, উৎসবে, স্নানে পুণ্য মেলায় মাতৃজাতির নিশ্চয় নিরাপত্তা নেই। এটি একটি কঠোর সত্য। শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীরা নয়- সর্ব শ্রেণীর নারী স¤প্রদায় এক বিরাট নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে- তার ফলে অনেক ক্ষেত্রে তারা আত্মপ্রসাদের পথে এগিয়ে যেতে পারছে না। পুরুষ সমাজের জন্য এ এক মারাত্মক কলঙ্কের কথা। কারণ পুরুষ সমাজটাই তো নারীর অবমাননা ও লাঞ্ছনার জন্য দায়ী। শাস্ত্র বলেছেন অল্প বয়সে পিতারূপী পুরুষ যৌবনে স্বামীরূপে পুরুষ ও নারীর বার্ধ্যক্যে পুত্ররূপী পুরুষ তাকে রক্ষা করবে, মর্যাদা সমুন্নত রেখে তাকে বিপদ বলয় থেকে দূরে রাখবে। পিতা, স্বামী ও পুত্র ছাড়াও সমাজে অনেক পুরুষ আছে তাদেরও এক বিশেষ কর্তব্য আছে। মাতৃজাতির মর্যাদা রক্ষা করা ও মাতৃমহিমাস্ফুরণের মহান ব্রতে এগিয়ে আসা তাদের সকলের কর্তব্য। আন্তরিক অধ্যাত্ম প্রস্তুতি ও সামাজিক শাসন এ দুয়ের সমন্বিত প্রভাবে বাস্তব মাতৃমহিমাস্ফুরণ সম্ভব হবে।
মাতা দশরূপ ধারণ করে কখনো শ্রীদশমহাবিদ্যায় স্থিতি হন। শ্রীশ্রীদশমহাবিদ্যা মূলত এক মহাবিদ্যা। এঁদের মধ্যে অভেদ জ্ঞান আয়ত্ত করতে হয়। এঁদের পৃথক মনে করাই অজ্ঞানতা ও পাপ। মানুষের জীবনে সাধন ও স্বাধ্যায়ের মাধ্যমে যদি মহাশক্তির উত্থান ঘটে তবেই তার সর্ববিদ্যা সিদ্ধি হয়। মাতৃশক্তির কাছে সম্পূর্ণ সমর্পিত হয়ে জীবনে সৌন্দর্য ও পূর্ণতা আনয়ন করা যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীঅরবিন্দ, শ্রীবামাক্ষেপা, শ্রীরামপ্রসাদ প্রমুখ মাতৃসাধকেরা দেখিয়েছেন মাতৃশক্তির মহাজাগরণের ফলে কি মহান রূপান্তর সম্ভব হয়। সমস্ত মনুষ্য জাতির আমূল রূপান্তরীকরণের জন্য। পরিব্যাপ্ত মাতৃশক্তির কাছে অবনত মস্তকে সমর্পিত হতে হবে। “The last stage of this perfection will come when you are completely identified with the Divine Mother and full yourself to be no longer another and separate being, instrument, servant, or worker but truly a child and eternal portion of her consciousness and forc.Ó (The mother: Sri Aurobindo)
অনন্ত মহা শক্তিময়ী মাতার চেতনার অবিচ্ছিন্ন অনন্ত অংশ হয়ে তাঁর পরম সন্তানে পরিণত হওয়ার সাধনা করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। এরই জন্যেই মাতৃপূজা-এ লক্ষ্য সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যই মাতৃ আবাহন। এই এক মহাশক্তিকেই দশদিকে সদাশিব দশমহাবিদ্যারূপে দর্শন করেছিলেন।
‘দশদিক্ষু মহাভীমা যা এতে সিদ্ধমূর্তয়ঃ।
সর্বে মমৈব মা শম্ভু ভয়ং কুরু মহামতো \’
সতীর এ বাণী মহাসত্য। দশদিক ব্যাপিনী মাতা একা, সর্বাদি ও সর্বশেষ। শিব যখন দশদিকে দশমূর্তি দর্শন করে বিমূঢ়, তাঁর সতীকে দেখলেন না, তখন মাতা অভয় দিয়ে বলেছিলেন- “শম্ভু ভয় করো না। দশদিকে দশমূর্তি সে আমিই।” যিনি ব্রহ্মময়ী তিনি নারীবপুধারিণী মাতা, আদ্যাশক্তি। মহাপুরুষদের জীবনে প্রতিফলিত মাতৃশক্তির কণামাত্র যদি আমার উপলব্ধি করতে পারি, তবে সমাজ জীবন থেকে নারী নিগ্রহ বিলুপ্ত হবে, মাতৃ অবমাননার চির সমাধি রচিত হবে এবং উত্থান ঘটবে এক বিশুদ্ধ বোধন শক্তির যার প্রভাবে সভ্যতা সুনির্মিতির দিকে এগিয়ে যাবে। মাতৃসাধনা, ত্যাগ, স্ত্রীজাতিতে মাতৃভাব, নারীর সম্মান উন্নীত করে রাখা আমাদের জন্মগত সংস্কার, পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত মহান আদর্শ।
দধিচি মুনির অস্থি রয়েছে আমাদের পঞ্জরে।
পার্থের তেজ সুপ্ত রয়েছে আমাদের অন্তরে \
আমাদের ঘরে জন্ম লভেছে স্বর্গের ভগবান।
আমরা রেখেছি চিরদিন এই ধর্মের সম্মান \
আজিও আমরা ব্যর্থ হবো না জীবনের সংগ্রামে।
মাতৃশক্তি শাশ্বত রবে চিরসনাতনী নামে \
আমাদের সুপ্তি ভাঙ্গুক, জাগুক মহাপ্রাণ। অভীমন্ত্রে আমরা এগিয়ে চলব; মাতৃসন্তান মায়ের আশীর্বাদে পরিপূর্ণতায় কনক সোপান বেয়ে সারাৎসারের দিকে ধাবিত হবো। আজকের মধুময়, ভক্তি চন্দন সিক্ত, মন্ত্রধ্বনি মুখরিত পূজার অঙ্গনে এ-ই আমাদের অনুপম অর্ঘা। মাতৃজাতির সম্মান বৃদ্ধি হোক, আমরা মাতৃভক্ত এ মহাজাতিতে রূপান্তরিত হই।

লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ এস্ট্রলজার্স সোসাইটি-কেন্দ্রীয় কমিটি, ঢাকা