মুহাম্মাদ কুতুব উদ্দীন
ফেব্রুয়ারি মাস এলেই সর্বস্তরে বাংলা চালু করার দাবি শোনা যায়। অপরদিকে আরেকটি মহল সর্বস্তরে বাংলা চালুর দাবিকে ইংরেজবিরোধী মনে করেন। এর কারণ হচ্ছে-দেশের বহু তরুণপ্রজন্ম বিদেশে কর্মসংস্থানের আশা করেন। আবার দেশেও যারা ভালো চাকরি আশা করেন তারা ইংরেজি ভাষার অদক্ষতা অনুুভব করেন। এ অবস্থায় বাংলা চালুর প্রস্তাবকে ইংরেজি থেকে আরও দূরে সরে যাওয়ার কারণ হিসেবে মনে করেন। এ ধারণাটি বিপজ্জনক। কেননা কোনো প্রস্তাব যদি রুটি-রুজির দিক হতে গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে তা বাস্তবায়নের সামাজিক আগ্রহ সৃষ্টি হয় না। কিন্তু এ ধারণায় মৌলিক গলদ আছে। সর্বস্তরে বাংলা চালুু করলে ইংরেজি শেখার আয়োজনে কোনো ঘাটতি তৈরি হবে এমন মনে করার কোনো ভিত্তি নেই। বরং বিপরীত উদাহরণই পৃথিবীজুড়ে অনেক বেশি। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি ব্যবহার করে এমন দেশগুলোর ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা কেমন, সে সম্পর্কে এক জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশের অবস্থান ৮২ তম, নেপালের দুই ধাপ নিচে; অন্যদিকে তালিকার উচ্চস্থানে আছে ঐ সব দেশ যারা পড়াশোনা নিজেদের ভাষায় করে এবং ইংরেজি শেখে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে। যেমন ডাচ, জার্মান, ফরাসি প্রভৃতি। এ তালিকায় সবচেয়ে মজার দেশটি সম্ভবত চীন।
আমরা সবাই জানি, চীনারা ইংরেজিতে খুবই অদক্ষ। বেশির ভাগ শিক্ষিত চীনা ইংরেজি ভাষার প্রাথমিক জ্ঞানই রাখেন না। কিন্তু ঐ তালিকায় চীনের অবস্থান বাংলাদেশ থেকে বহু ওপরে। কারণ চীনাদের মধ্যে যারা ইংরেজি শেখে তারা খুব পেশাদার কায়দায় দক্ষভাবেই শেখে। বাংলাদেশে আমরা ইংরেজি শেখার ব্যাপারে যথেষ্ট উদার হওয়া সত্তে¡ও সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। বাংলা ও ইংরেজির মধ্যে মূলত কোনো বিরোধমূূলক সম্পর্ক নেই। পৃথিবীর সর্বত্রই দ্বিতীয় ভাষা শেখানো হয়। গবেষণা বলছে, প্রথম ভাষা দক্ষতার সাথে আয়ত্ত করতে পারলে অনেক ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ভাষা শিখতে বেশি সাহায্য করে। অধিকাংশ মানুষের ধারণা ইংরেজিতে দক্ষ হলেই ভালো চাকরি পাওয়া যায়। কথাটি কিছু ক্ষেত্রে সত্য বটে। এ কথাটির সব সত্য হলে ইংরেজি ভাষাভাষী সবাই উন্নত জীবনযাপন করত। উল্লেখ্য, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়া ছাড়াও অসংখ্য মানুুষের প্রথম ভাষা ইংরেজি। শুধুু ইংরেজি ভাষা জানার কারণেই তারা কিন্তু উন্নত পেশায় অধিষ্ঠিত হচ্ছে তা নয়। আমাদের মনে রাখা দরকার,ইংরেজি ভাষা শিক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকল্প নয়। অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে ইংরেজিকে বিবেচনা করতে হবে। যেমন আমরা বর্তমানে কম্পিউটার স্কিলকে দেখি। বিদেশি ভাষা চর্চার ব্যাপারে আমার একটি প্রস্তাবনা বিবেচনার নিমিত্তে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের উদ্দেশ্যে পেশ করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি।
মাতৃভাষা হিসেবে আমাদেরকে প্রথমে বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাকে আমরা চরমভাবে অবহেলা করছি। আমাদের অনেকই মাতৃভাষার চর্চা না করে বিদেশী ভাষা চর্চা করাকে বেশি গৌরবের মনে করে এবং অনেক ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলাটা অপমানজনক মনে করে; যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্যে বেদনার। তাই মাতৃভাষা বাংলাকে আর অবহেলা না করে বরং এ ভাষাকে উন্নত করার উদ্দেশ্যে সঠিক বাংলা বানানরীতি চর্চা করতে হবে, সাধু ও চলিত রীতির পার্থক্য সম্পর্কে অবগত হতে হবে, অফিস-আদালতের যাবতীয় কার্যাবলি বাংলায় লিখতে হবে, প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে বংলা মাধ্যমে পাঠদান বাধ্যতামূলক করতে হবে, বিদেশি ভাষায় লিখিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বই বাংলায় অনুবাদ করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই স্ব জাতির ভাষায় খুত্বা দেয়া হলেও আমাদের দেশে তা করা হয় না। ফলে খুত্বার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। এ জন্যে জুমুআর খুত্বাসহ সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্যে বাংলা ভাষায় সঠিক পন্থায় ইসলামের সৌন্দর্য জনসাধারণের কাছে তোলে ধরতে হবে এবং জাতীয় দিবসগুলোর ক্ষেত্রে বঙ্গাব্দ অনুসরণ করতে হবে। কারণ সংশ্লিষ্ট কোনো ভাষায় কথা বলার লোক না থাকলে বা সেই ভাষাকে অবহেলা করলে সেই ভাষার মৃত্যু অবধারিত। কষ্ট থেকে বলতে বাধ্য হচ্ছি,অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যানার,সাইনবোর্ড,পোস্টার,লিফলেট, নথিপত্রে বাংলা বানানের প্রতি যথেষ্ট অবহেলা করা হয়,বলতে গেলে গুরুত্ব দেয়া হয় না। আমার চৌদ্দ বছরের শিক্ষকতাজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি-প্রাথমিক থেকে উচ্চস্তরের অধিকাংশ শিক্ষার্থী শতভাগ সঠিক বানানে ও রীতিতে দরখাস্ত লিখতে পারে না; যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্যে খুবই লজ্জাজনক। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে আরবী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা যায়। কেননা আরবী জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। বৈদেশিক রেমিট্যান্সের শতকরা ৮০ ভাগ আসে আরবী ভাষাভাষী দেশ থেকে। অর্থনৈতিক এ গুরুত্ব বিবেচনা করে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মধ্যপ্রাচ্যগামী শ্রমশক্তিকে ভাষাগত দক্ষ করে গড়ে তোলতে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। তাই জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে দক্ষ ও পারদর্শী জনশক্তি তৈরি করে রেমিটেন্সের ধারা অব্যাহত রাখার নিমিত্তে আরবী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা যেতে পারে। তৃতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জন করা যেতে পারে। কিন্তু মাতৃভাষাকে অবহেলা করে কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। মাতৃভাষা মহান আল্লাহর বড় একটি নেয়ামত। মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারা বা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারার অনুভূতিই আলাদা। আল্লাহ রাব্বুল আলমীন মানবজাতির পথপ্রদর্শনের জন্যে যত আসমানী গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন সবগুলোই স্ব জাতির ভাষায় অবতীর্ণ করেছেন। কুরআন মাজীদের সূরা ইবরাহীমের ৪ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন : ‘আমি নিজের বাণী পৌঁছাবার জন্যে যখনই কোনো রাসূল পাঠিয়েছি, তিনি তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের ভাষায় বাণী পৌঁছিয়েছেন, যাতে তিনি তাদেরকে খুব ভালো করে সুস্পষ্টভাবে বুঝাতে পারেন।’
সূরা ইউসুফের ২ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন : ‘আমি একে আরবী (মাতৃ) ভাষায় কুরআন বানিয়ে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা (আরববাসীরা) একে ভালোভাবে বুঝতে পারো।’ তাইতো মহান আল্লাহ মূসা আলাইহিস সালাম-এর ওপর তাওরাত কিতাব ইবরানী ভাষায়, দাঊদ আলাইহিস সালাম-এর ওপর যাবূর কিতাব ইউনানী ভাষায়, ঈসা আলাইহিস সালাম-এর ওপর ইঞ্জিল কিতাব সুরিয়ানী ভাষায় এবং সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর মহাগ্রন্থ কুরআন মাজীদ স্ব জাতির ভাষা আরবীতেই অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ যে সম্প্রদায়ের মধ্যে যে নবী পাঠিয়েছেন তাঁর ওপর তাঁর ভাষায়ই নিজের বাণী অবতীর্ণ করেছেন। এর উদ্দেশ্য ছিল সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায় যেন তা ভালোভাবে বুঝতে পারে এবং পরবর্তীতে তারা যেন এ ধরনের কোনো আপত্তি পেশ করতে না পারে যে, নবীদের পাঠানো শিক্ষা তো আমরা বুঝতে পারিনি (মাতৃভাষায় না পাঠানোর কারণে) কাজেই কেমন করে তাঁর প্রতি ঈমান আনব? আর আল্লাহ কখনও নিছক অলৌকিক ক্ষমতা দেখাবার জন্যে অপিরিচিত ভাষায় নিজের বাণী শুনাননি। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলতেন।
লেখক : প্রভাষক (আরবী), জলদী হোসাইনিয়া কামিল (স্নাতকোত্তর) মাদরাসা, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম