ফারুক আবদুল্লাহ
নানামুখী জটিলতার অবসান ঘটিয়ে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে শুরু হচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণকাজ। এটি হবে দেশের অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’। বন্দরটি চালু হলে পাল্টে যাবে দেশের অর্থনীতির চেহারাও। এ লক্ষ্যে আজ মঙ্গলবার ঢাকায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জাপানের দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চ‚ড়ান্ত নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষর হবে। এর পরেই শুরু হবে টার্মিনালের নির্মাণকাজ। আগামী ২০২৯ সালের মধ্যেই মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরে বাণিজ্যিকভাবে কার্যক্রম চালু হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, নানমুখী জটিলতার কারণে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পের খরচ দুই দফায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকায়। আর প্রথম পর্যায়ে যে টার্মিনাল নির্মাণ হচ্ছে, তার খরচ ধরা হয়েছে ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর পুরোটাই বহন করবে জাইকা। এ লক্ষ্যে জাপানের দুই প্রতিষ্ঠান পেন্টা-ওশান কনস্ট্রাকশন ও টিওএ কর্পোরেশনের সঙ্গে আজ চুক্তি করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ৪ বছরে ৪৬০ মিটার দীর্ঘ একটি কন্টেইনার জেটি এবং ৩০০ মিটার দীর্ঘ একটি মাল্টি পারপাস জেটিসহ টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। দুইটি জেটিতে একইসাথে বড় আকৃতির তিনটি, মাঝারি আকৃতির হলে চারটি মাদার ভ্যাসেল বার্থিং দেয়া সম্ভব যাবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, মাতারবাড়িকে কেন্দ্র করে যে বিশাল বিনিয়োগ পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে দেশের অর্থনীতির চেহারাও। কারণ এখানে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, তার প্রতিটিই দেশের অর্থনীতিতে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে ভ‚মিকা রাখবে। এখানে উন্নত যোগাযোগ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, বন্দর, পর্যটনসহ বিভিন্ন খাত নতুন করে স্থাপন করা হচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনে সহায়ক হবে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্প ও বাণিজ্য প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। সেই সঙ্গে শিল্পের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
জানা যায়, মাতারবাড়িকে ‘এনার্জি হাব’ হিসেবে গড়ে তুলতে এলএনজি টার্মিনাল, এলপিজি টার্মিনাল, অয়েল টার্মিনাল, গ্যাস ট্রান্সমিশন এবং সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। অন্যদিকে, ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব’ হিসেবে গড়ে তুলতে অয়েল রিফাইনারি, এনার্জি ও ফুড স্টোরেজ, ট্যুরিজম, এমব্যাঙ্কমেন্ট ও ওয়াটারফ্রন্ট ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার কাজও চলছে।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) পক্ষ থেকে সংস্থাটির প্রধান প্রতিনিধি ইচিগুচি টোমোহাইড ‘মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ’ নিয়ে উপস্থাপনায় বলেন, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক অঞ্চলও হচ্ছে। সব মিলিয়ে এমআইডিআই অঞ্চলকে ঘিরে এই অঞ্চলে তিনটি ‘হাব’ বা অর্থনৈতিক কেন্দ্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। এগুলো হলো, লজিস্টিক হাব, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি হাব এবং শিল্প হাব। এই করিডর বাংলাদেশের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশের আন্তঃযোগাযোগের ক্ষেত্রে ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
‘মাতারবাড়ি পোর্ট ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। কিন্তু এরই মধ্যে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে মোট ব্যয় ধরা হয় ১৭ হাজার ৮০৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এবার দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ৬ হাজার ৫৭৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বাড়িয়ে মোট ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি ৪০ লাখ টাকা করা হয়। সেই সঙ্গে প্রকল্পের মূল মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এখন নতুন করে ৩ বছর বাড়িয়ে ২০২৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, আগামীকাল মঙ্গলবার (আজ) চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে জাপানের দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হবে। এর পরেই শুরু হবে টার্মিনালের নির্মাণকাজ। আগামী ২০২৯ সালের মধ্যেই মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরে বাণিজ্যিকভাবে কার্যক্রম চালু হবে বলে আমরা আশাবাদী।
তিনি বলেন, বন্দরটি চালু হলে পৃথিবীর যেকোন দেশে সরাসরি জাহাজ চলাচল করতে পারবে। পণ্য নিয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আর সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার বন্দরে অপেক্ষায় থাকতে হবে না। এর ফলে সময় সেইভ হবে ২০ থেকে ২৫ দিন। একইভাবে ভাড়া সেইভ এর পাশাপাশি কমোডিটি প্রাইজ কমে যাবে। আর মাতারবাড়িতে ২৪ ঘন্টা অপারেশন কার্যক্রম করতে পারবে। জাহাজের হ্যান্ডলিং সক্ষমতা অনেকগুণ বাড়বে।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, এই বন্দরকে কেন্দ্র করে মহেশখালী-মাতারবাড়িতে বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠবে। অনেক বড় বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। একারণে মাতারবাড়ি হবে দেশের অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।