
নোমান উল্লাহ বাহার
বাংলার মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর নাম চিরস্মরণীয়। ধর্ম, শিক্ষা, সমাজসংস্কার,
সাংবাদিকতা ও রাজনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন
অনন্য পথপ্রদর্শক। এক হাতে কলম, অন্য হাতে কর্ম-এই দ্বিমাত্রিক শক্তিতেই তিনি দেখিয়েছিলেন, একটি জাতির মুক্তি আসে জ্ঞান, মানবিকতা ও যুক্তিবোধের সমন্বয়ে। ১৮৭৫ সালে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার আড়ালিয়া গ্রামে জন্ম নেন ইসলামাবাদী। পিতা মুন্সী মতিউল্লাহ ছিলেন আরবি ও ফারসিতে পন্ডিত শিক্ষক, যাঁর কাছ থেকেই তিনি নৈতিকতা ও শিক্ষার প্রথম পাঠ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে কলকাতার মাদ্রাসা আলিয়া থেকে “জামাতে উলা” সম্পন্ন করে “মাওলানা” উপাধি অর্জন করেন। শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবনের সূচনা হলেও তিনি দ্রুত বুঝেছিলেন-শিক্ষাই জাতির জাগরণের মূল শক্তি। তাই পাঠদানে সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা, কদম মোবারক এমওয়াই উচ্চ বিদ্যালয় ও বরকল এসজেড স্কুলসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন, যেগুলো সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়। তাঁর শিক্ষা-দর্শন ছিল প্রগতিশীল ও বাস্তবভিত্তিক। তিনি মনে করতেন, ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ইতিহাস ও ভ‚গোল শেখানো প্রয়োজন-কারণ জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ রাখলে জাতি কখনো মুক্ত হতে পারে না। তাঁর সেই দৃষ্টিভঙ্গিই আজকের “সমন্বিত শিক্ষা” ধারণার প্রাচীন ভিত্তি হিসেবে বিবেচ্য। সাংবাদিকতা ছিল ইসলামাবাদীর জাগরণ আন্দোলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তিনি সম্পাদনা করেছেন আল-এসলাম, সোলতান, হাবলুল মতিন, বাসনা ও মুহাম্মদী পত্রিকা। এসব মাধ্যমে প্রচার করেছেন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সামাজিক সংহতির বার্তা। মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি প্রথমদিকেই বাংলাকে জাগরণের ভাষা হিসেবে তুলে ধরেন। আল-এসলাম পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন, “পুঁথি সাহিত্য ও সংস্কৃতিমূলক সাহিত্যের মাঝখানেই আমাদের বাংলা ভাষার স্থান।” হিন্দি-উর্দু বিতর্কের সময় তিনি নির্ভীকভাবে বাংলার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন-যা পরবর্তী ভাষা আন্দোলনের মানসিক ভিত্তি তৈরি করেছিল।
ইসলামাবাদীর চিন্তায় নারীশিক্ষা ছিল সমাজ সংস্কারের অন্যতম স্তম্ভ। তিনি বলেছিলেন, “যখন পুত্রকন্যার মা হইবে, তখন তাহাদের কেবল অলংকার পরাইবার চিন্তা করিও না, তাহাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করিও।” এক শতাব্দী আগে উচ্চারিত এই আহŸান আজও নারী অধিকার ও শিক্ষার প্রসারে অনুপ্রেরণার উৎস।
রাজনীতিতে ইসলামাবাদী ছিলেন সাহসী সংগ্রামী। ১৯০৬ সালে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন, খেলাফত, অসহযোগ ও কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। তিনি গড়ে তোলেন ‘আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙালাহ’-যার মুখপত্র আল-এসলাম ছিল বাংলা ভাষায় প্রথম মুসলিম পত্রিকা। তাঁর স্বপ্ন ছিল চট্টগ্রামে এমন এক আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাও থাকবেÑযা আজকের “মাদ্রাসা সংস্কার” আলোচনার সঙ্গে বিস্ময়করভাবে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ব্রিটিশবিরোধী কার্যক্রমের কারণে ১৯৪৪ সালে তিনি কারাবরণ করেন, দিল্লি ও পাঞ্জাবের জেলখানায় ১১ মাসের নির্যাতনের পর মুক্তি পান। ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তাঁর ভাবনা আজও জীবন্ত-যেখানে শিক্ষা শুধু ডিগ্রির বিষয় নয়, বরং নৈতিকতা, যুক্তিবোধ ও সমাজচেতনার বিকাশের মাধ্যম। চট্টগ্রামের মাটিতে তাঁর সমাধিফলকে খোদিত ফারসি কবিতার বাংলা অনুবাদে লেখা রয়েছে-
“পথিক, ক্ষণিকের তরে বস মোর শিরে,
ফাতেহা পড়িয়া যাও নিজ নিজ ঘরে,
যে জন আসিবে মোর সমাধির পাশে,
ফাতেহা পড়ে যাবে মম মুক্তির আশে।”
আজকের বাংলাদেশে যখন সমাজে বিভাজন, অন্ধত্ব ও অসহিষ্ণুতা ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে, তখন ইসলামাবাদীর জীবন ও দর্শন আমাদের জন্য অনন্য প্রেরণা। তিনি দেখিয়েছিলেন-শিক্ষা, মানবিকতা ও যুক্তিবোধের সমন্বয়ই প্রকৃত উন্নতির পথ। তাই আজকের প্রজন্মের দায়িত্ব তাঁর চিন্তা ও আদর্শকে নতুন প্রেক্ষাপটে পুনরায় প্রয়োগ করা; শিক্ষা ও সমাজে নৈতিকতার চর্চা, ধর্মে সহিষ্ণুতা, আর রাজনীতিতে সত্যনিষ্ঠ নেতৃত্ব গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই ইসলামাবাদীর জাগরণের আলো আমাদের বর্তমানকে আলোকিত করতে পারে।
লেখক : প্রাবন্ধিক











