মাইনী খালের মাটি দিয়ে ভরাট হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদ!

20

এম কামাল উদ্দিন, রাঙামাটি

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে প্রবাহিত মাইনী নদী মিলেছে রাঙামাটির লংগদু কাচালং নদীর সঙ্গে। ষাটের দশকের আগে এই মাইনী নদী পাড়ি দিয়ে রাঙামাটির বিভিন্ন হাটবাজারে আসতেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। সেই মাইনী নদীর যৌবন এখন আর নেই। মৃতপ্রায় মাইনী নদীর নৌ-পথ খননের উদ্যোগ নিয়েছে খাগড়াছড়ি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। লংগদু উপজেলার মাইনীমুখে বন বিভাগের বিশ্রামাগার এলাকার অংশে এখন চলছে খনন কাজ। তবে নদী খননের বালি দিয়ে ভরাট হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদ। বাজার সম্প্রসারণের নামে কাপ্তাই হ্রদের বিস্তীর্ণ অংশ ভরাট করছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ একটি চক্র।
সরেজমিনে দেখা যায়, লংগদু উপজেলার মাইনীমুখে বন বিভাগের বিশ্রামাগারের পাশে মাইনী নদীতে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে নদী খননের কাজ করছে পাউবো। আর নদী খননের বালি লোহার পাইপলাইন দিয়ে মাইনীমুখ বাজারের পাশে কাপ্তাই হ্রদে ফেলা হচ্ছে। হ্রদ ভরাট করে বালুচর বানানো হচ্ছে। সেজন্য আগে থেকেই কাপ্তাই হ্রদের দুই অংশের মধ্যে মাটি দিয়ে বাঁধ দেয়া হয়েছে। বাঁধ দেয়া জায়গাটি আনুমানিক দুই থেকে তিন একর হবে। ভরাটের কারণে বাঁধ চুইয়ে বালি ও পানির কারণে বাঁধের বাইরে কাপ্তাই হ্রদের অংশটিও চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কমেছে কাপ্তাই হ্রদে মাছ চাষাবাদের ভূমিও। ভরাটকৃত জায়গাটিতে মাইনীমুখ বাজার সম্প্রসারণ করা হবে। এ কাজটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাইনীমুখ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল হোসেন কমল।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, প্রতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে এলে হ্রদ ভরাটের মহোৎসব দেখা হয়। ক্রমাগত হ্রদের অংশ বেদখল হয়ে যাচ্ছে। হ্রদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কারণে দখলদার ও ভূমিদস্যুরা বেশ সক্রিয় হয়ে উঠছে। তারা কাপ্তাই হ্রদের অবৈধ বেদখল ঠেকাতে প্রশাসনকে কার্যকর পদক্ষেপের তাগিদ দিয়েছেন।
মাইনীমুখ বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, ‘কলাবাজার, গরু বাজার, কাঠ বাজারের কারণে মাইনীমুখ বাজারের জায়গা সংকুচিত হয়েছে। মৌখিকভাবে চেয়ারম্যান আমার সঙ্গে সমন্বয় করছেন যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাটি যদি এখানে ফেলা হয় সেক্ষেত্রে বাজারটা সম্প্রসারণ করা যাবে। যে কোনো সময় অবৈধ দখলদার পেছনের দিকে যাচ্ছে; সেটি ঠেকাতে এসিল্যান্ড সার্ভেয়ার দিয়ে ম্যাপ করেছেন। এরপর সেখানে লাল পতাকা টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। মাটি ভরাটের পর জায়গাটি জেলা প্রশাসকও নিতে পারেন কিংবা বাজার সম্প্রসারণের জন্যও দিতে পারেন।’
মাইনীমুখ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল হোসেন কমল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মাইনীমুখ বাজারটি অত্র এলাকার মধ্যে একটা বড় বাজার। কিন্তু হাটবারে বাজার বসার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। তাই বাজারটি সম্প্রসারণের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মাইনী নদী যখন খনন করা হচ্ছে তখন আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলেছি নদী খননের মাটিগুলো যদি এখানে ভরাটের জন্য ফেলা হয় তাতে আমাদের সুবিধা হয়। তাই জায়গা ভরাটের জন্য এখানে মাটি ফেলা হচ্ছে।’
লংগদু উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড লাল পতাকা দিয়ে লে-আউট দিয়েছে যাতে করে স্থানীয়রা কাপ্তাই হ্রদের খাস জায়গা ব্যবহার ও চাষাবাদ না করে। লে-আউটের বাহিরের জায়গা কেন ভরাট করা হচ্ছে সেটি পানি উন্নয়ন বোর্ড ভালো জানতে পারবে। তবে আমি যতদূর জানি সেখানে মাইনীমুখ ইউনিয়ন পরিষদ ও বিদ্যালয়ের মাঠের জায়গা রয়েছে। ইউপি পরিষদের স্থায়ী ভবন ও বিদ্যালয়ের মাঠ সম্প্রসারণের জন্য জায়গা ভরাট করতে পারে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাউবো খাগড়াছড়ির উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমার প্রকল্পের স্টাডিতেই উল্লেখ আছে ড্রেজিং করা মাটি-বালি যদি কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও স্কুলের জন্য চাহিদা থাকে সেক্ষেত্রে আমরা তাদের দান করে দিতে পারবো। এক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে ট্রাক কিংবা পরিবহনের খরচ তারা দেবেন। মাইনীমুখ ইউপির চেয়ারম্যানসহ স্থানীয়দের চাহিদার ভিত্তিতে তাদের বালিগুলো দেওয়া হচ্ছে।’
দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি রাঙামাটি জেলা সভাপতি মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘নদীর নৌ-পথ খননের মাটি দিয়ে ভরাট করে যদি নৌ-ঘাট বন্ধ হয়ে যায় হ্রদ ভরাট করা হয়; তাহলে এটি তো পরিবেশবিধ্বংসী কাজ এবং বড় ধরনের অপরাধ। স্থানীয় প্রশাসন লাল পতাকা দেওয়ার পরও যদি সেখানে কাপ্তাই হ্রদের জলাধার ভরাট হয়ে থাকে তাহলে তারা প্রশাসনকে মানছে না। আমি প্রশাসনকে অনুরোধ জানাব এ ধরনের পরিবেশবিধ্বংসী অপতৎপরতা ঠেকাতে যেন দ্রæত পদক্ষেপ নেয়া হয়।’
কাপ্তাই হ্রদে মাছ চাষের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙামাটি বিপণন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক কমান্ডার মো. আশরাফুল আলম ভূঁইয়া জানান, ‘কাপ্তাই হ্রদের মৌলিকত্ব রক্ষায় আমাদের যা যা করণীয় সবই করব।’
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের কাছে এখনো পর্যন্ত অভিযোগ আসেনি। আমি এ বিষয়ে অবগত নই। ইউএনও’র মাধ্যমে সরেজমিন পরিদর্শন করে এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের (রাঙামাটির অতিরিক্ত দায়িত্ব) সহকারী পরিচালক আফজারুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি আমরা অবগত আছি। আমি ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেছি। হ্রদ ভরাটের ঘটনায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, বাজার সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, বাজার চৌধুরীসহ স্থানীয় নেতাদের নাম প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছি। বিষয়টি আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’