অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইকবাল
হযরত মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩ খ্রি. (১৩ ফাল্গুন ১২৯৯ বাংলা) তারিখে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভান্ডার গ্রামের মাইজভান্ডার দরবার শরিফের প্রথম মোন্তাজেম, বেলায়তে মা’আব হযরত মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ ফয়জুল হক মাইজভান্ডারীর (১৮৬৫-১৯০২) এবং সৈয়দা ওয়াজেদা বেগমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামহ বাংলাদেশে প্রবর্তিত একমাত্র ত্বরিকা ‘ত্বরিকায়ে মাইজভান্ডারীয়া’র প্রবর্তক হযরত গাউসুল আযম মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (১৮২৬-১৯০৬)। তিনি পিতা-মাতার দ্বিতীয় সন্তান। তাঁর অগ্রজ হযরত সৈয়দ মীর হাসান (১৮৯১-১৯০৬)। মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতাকে হারান। এরপর দাদা-দাদির স্নেহ-মমতায় লালিত-পালিত হতে থাকেন। ১৩ বছর বয়সে দাদাও ইন্তিকাল করেন। এরপর থেকে শুধু দাদির কাছে থেকে বেড়ে উঠেন। ৫ বছর বয়সে দাদার হতেই তাঁর হাতেকড়ি হয়। এরপর মাওলানা অলি উল্লাহ ছিলেন তাঁর প্রথম গৃহ শিক্ষক। পরবর্তীতে মাওলানা হাফেজ ক্বারী তফাজ্জল হোসাইন তাঁর গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত হন। এই শিক্ষকের প্রভাব তাঁর জীবনে সুদুর প্রসারী ছিল। তাঁর নামেই ‘তফাজ্জল মেমোরিয়াল লাইব্রেরী’ প্রতিষ্ঠা করেন সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী। পাঠ্য বই এর পাশাপাশি তিনি ইসলামী চিন্তবিদগণের লিখিত তাফসির-হাদিস সংকলন-ফিকাহ-দর্শন সহ বিভিন্ন বিষয়ের রচিত গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকা পাঠ করতেন। তিনি নিজ গৃহ শিক্ষকের নিকট মোট ১৭ দিন বাংলা শিখেন। এরপর আর কোন শিক্ষকের কাছে বাংলা পড়েন নি। তিনি মুহসিনিয়া মাদরাসায় অধ্যয়নের মাধ্যমে শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেন।
মাত্র ১৭ দিন বাংলা শিখলেও তিনি যে মোট ১২টি গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছেন, তার সবকটিই ছিল প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় রচিত। বিখ্যাত ‘বেলায়তে মোত্লাকা’ গ্রন্থ ছাড়া তাঁর রচিত ও সম্পাদিত বাকি গ্রন্থগুলো হলো- ১. গাউসুল আযম মাইজভান্ডারীর জীবনী ও কেরামত (সম্পাদিত, প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৭, পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৪৮), ২. মুসলিম আচার-ধর্ম (প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৯), ৩. মিলাদে নববী ও তাওয়াল্লোদে গাউছিয়া (প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৯, ১৭ স- ২০১৭, পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২২), ৪. গঠনতন্ত্র (প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৯), ৫. মূলতত্ত¡ বা তজকীয়ায়ে মোখতাছার (১ম খন্ড) (প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৯, ১০ স- ২০১৭, পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩২), ৬. মূলতত্ত্ব বা তজকীয়ায়ে মোখতাছার (২য় খন্ড) (এই পান্ডুলিপিটি অপ্রকাশিত), ৭. প্রতিবাদ লিপি (প্রথম প্রকাশ: ১৯৭২), ৮. জীবনস্মৃৃতি (অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি, রচনাকাল- ১৯৭২), ৯. এলাকার রেনেসাঁ যুগের একটি দিক (প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৪, পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৬০), ১০. বিশ্ব-মানবতায় বেলায়তের স্বরূপ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৪, পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৯), ১১. মানব সভ্যতা (প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৫)। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীর মাধ্যমেই মহাসমুদ্র রূপী মাইজভান্ডারীয়া ত্বরিকার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপিত হয়। তাই তিনি মাইজভান্ডারীয়া ত্বরিকার স্বরূপ উন্মোচক হিসেবে সবার কাছে সমমাত্রায় সমাদৃত।
তাঁর রচিত ‘বেলায়তে মোত্লাকা’ গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় রচিত মৌলিক তাসাউফ গ্রন্থ এবং বিশ্ব তাসাউফ সাহিত্যের অনন্য সংযোজন। গ্রন্থটি সমৃদ্ধ মাইজভান্ডারী সাহিত্যেরও গুরুত্বপূর্ণ রচনা। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে রচিত হলেও তাসাউফের এই যুগোপযগী গ্রন্থ অধ্যয়নের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গ্রন্থে উপস্থাপিত ধারণা সমূহ (Concepts), বিষয় ও পরিভাষা প্রতি নিয়ত গবেষক, দার্শনিক, লেখক, ধর্মীয় চিন্তাবিদগণের সামনে গবেষণার দ্বার উন্মোচন করছে। এটা শুধু মাইজভান্ডারী দর্শনের আকর গ্রন্থই নয়, বরং একেশ্বরবাদীদের ধর্ম ঐক্যের এক অনন্য তাত্ত্বিক গ্রন্থও বটে। এ গ্রন্থের আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য এবং এর অপরিহার্যতা বিষয়ে গ্রন্থাকারের মূল্যবান মন্তব্য- “মানবের দৈহিক সুস্থতা ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সুষ্ঠুতা যেমন দরকারী ও মূল্যবান, মানসিক সুষ্ঠুতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সুষ্ঠুতাও তেমনি নিতান্ত প্রয়োজন। যাহার অভাবে মানব দ্বীন-দুনিয়াতে বিশেষ করিয়া ধর্মীয় ক্ষেত্রে ধর্মান্ধ বা ধর্ম-গোড়া হইতে বাধ্য হইয়া থাকে। সুস্থ মানসিকতা ও নিরপেক্ষ মনোভাব লইয়া যাঁহারা এই তত্ত্ব অনুধাবন করিবার মানসে এই ক্ষুদ্র গ্রন্থখানি পাঠ করেন তাঁহাদের করকমলে ত্বরিকতের একজন নগন্য খাদেম হিসেবে সেবার নিদর্শন স্বরূপ এই গ্রন্থখানি উপস্থিত করিলাম। উপকৃত মনে করিলে নিজেকে কৃতার্থ মনে করিব। আশা করি দোষ ত্রুটি নিজ গুণে ক্ষমা করিবেন।”
সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী ছিলেন তাঁর পিতামহ হযরত গাউসুল আযম মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী কর্তৃক মনোনীত অছি (Vicegerent) হিসেবে মাইজভান্ডারীয়া ত্বরিকার আধ্যাত্মিক উত্তারাধিকারী স্থলাভিষিক্ত এবং অন্য দিকে তিনি ছিলেন এই ত্বরিকার তাত্ত্বিক বিশ্লেষক ও স্বরূপ উন্মোচক।
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি গাউসুল আযম বিল বিরাসাত হযরত মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবা ভান্ডারীর (১৮৬৫-১৯৩৭) দ্বিতীয় কন্যা সৈয়দা সাজেদা খাতুনকে (রা.) বিবাহ করেন। সংসার জীবনে তিনি ছিলেন ৫ পুত্র ৬ কন্যা সন্তানের জনক।
তিনি মানব সেবায় সর্বদা নিয়োজিত থাকতেন এবং জনকল্যাণমূলক কাজে সবাইকে উৎসাহিত করতেন। তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জুনিয়র মাদরাসা, পাঠাগার, কিচেন কমিটি (দুর্ভিক্ষের সময় দুস্থদের সেবার জন্য, ১৯৪৩), সামাজিক-আধ্যাত্মিক সংগঠন সহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান-সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি তিনি দরবার স্টোর নামে একটি দোকান ও ভান্ডার শরিফ এগ্রিকালচারাল ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ১৬ জানুয়ারী, ২ মাঘ ১৩৮৮ বাংলা তারিখ তিনি দীর্ঘ কর্মময় জাগতিক ও আধ্যাত্মিক বিচিত্র বর্ণাঢ্য জীবন সামাপ্ত করে এবং মাইজভান্ডারী ত্বরিকা ও দরবার শরিফকে প্রাতিষ্ঠানিক সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আজ ২ মাঘ মহান আধ্যাত্মিক সাধক, সমাজ সংস্কারক হযরত মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারীর (ক.) ইন্তিকাল দিবসে তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর ফয়েজ ও তাওয়াজ্জু লাভের তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : আইনজীবী, গবেষক, আবরি বিভাগ, চ.বি.