ডা. প্রধীর রঞ্জন নাথ
মহিলার রজোনিবৃত্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মূত্রপথ দিয়ে রক্তস্রাব হওয়াকে রজোনিবৃত্তির পর ঋতুস্রাব বলে। রজোনিবৃত্তির পর ঋতুস্রাব হলে তা অনেকাংশে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত প্রজননকালের শেষ দিকে একবছর মাসিক বন্ধ থাকলে রজোনিবৃত্তি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে বর্তমানে কিছু কিছু চিকিৎসা বৈজ্ঞানিকের মতে ৬ মাস বন্ধ থাকলে তাকে রজোনিবৃত্তি বলা উচিত। রজোনিবৃত্তির আগে বহু মহিলার অনিয়মিত, অস্বাভাবিক, অতিরিক্ত ঋতুস্রাব হয় বলে রজোনিবৃত্তির পর মহিলারা অনেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। কিন্তু এরপরে ঋতুস্রাব হলে তাদের আতঙ্কিত ও বিপর্যস্ত করে তোলে। চিকিৎসকও তাকে আশ্বস্ত করতে পারে না যতক্ষণ না পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাকে জবাব দেওয়া হয় না কোন ক্যানসার জাতীয় রোগ নেই। তাই রজোনিবৃত্তির পর কম বেশি যে পরিমাণই রক্তস্রাব হোক না কেন তা অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ এসব ক্ষেত্রে এক-তৃতীয়াংশ ক্যানসারজনিত কারণে হয়। আবার ৫৫ বছরের পরও যখন স্বাভাবিক ঋতুচক্র আবর্তিত হয় তাও একইরকম গুরুত্বপূর্ণ এবং তার কারণ অনুসন্ধান করা উচিত।
কত বছর বয়সে রজোনিবৃত্তি হয় : ভারতবর্ষে রজোনিবৃত্তির গড় বয়স ৪৭ বছর। পাশ্চাত্য ও উন্নত বিশ্বে রজোনিবৃত্তির গড় বয়স ৫০ বছর।
রজোনিবৃত্তির বয়স কিসের ওপর নির্ভর করে : যে সমস্ত নারী অপুষ্টিতে ভোগে তাদের ঋতুবন্ধের গড় বয়স ৪০ বছর। যে সব মহিলা ধূমপান করেন তাদের রজোনিবৃত্তি যারা ধূমপান করেন না তাদের তুলনায় দু’বছর আগে হয়ে যায়। নারীর ঋতুবতী হওয়ার বয়স, সন্তান সংখ্যা, উচ্চ সামাজিক অবস্থা, উচ্চশিক্ষা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন ইত্যাদি বিষয়গুলো দেরি করে ঋতুবন্ধ হওয়ার কারণ হতে পারে। কিন্তু সদা সর্বদা এমনটি দেখা যায় না।
রজোনিবৃত্তিকালে হার্ট ও রক্তসংবহন তন্ত্রের পরিবর্তন : রজোনিবৃত্তির পর মহিলাদের হার্টের রোগের বিপদ বেড়ে যায় যতদিন ডিম্বাশ্বয়ের কার্যক্ষমতা থাকে অর্থাৎ যতদিন স্ত্রী-সেক্স হরমোন এস্ট্রোজেন তৈরি করতে পারে ততদিন এটা হার্টকে রক্ষা করে। কারণ এস্ট্রোজেন হরমোন রক্তসংবহন তন্ত্রের স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখে এবং এর অভাবের ফলে অ্যাথেরোস্কে¬রোটিক রোগ বৃদ্ধি পায়। ঋতুবন্ধের পর রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাই হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন অর্থাৎ এইচডিএল যা হার্টের বন্ধু, তা রক্তে কমে যায় এবং লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন অর্থাৎ এলডিএল যা হার্টের শত্রু তা বৃদ্ধি পায়। এই জন্য রজোবন্ধের পর মহিলাদের হার্টের রোগ বৃদ্ধি পায় এবং তা পুরুষ মানুষের প্রায় সমান।
রজোনিবৃত্তির পর ঋতুস্রাব হওয়ার কারণ :
* প্রজনন অঙ্গের ক্যানসার : সার্ভিক্স, এন্ডোমেট্রিয়াম, যোনি, বহিঃ প্রজনন অঙ্গ, ডিম্ব সঞ্চালন নালী ও ডিম্বাশয়ের ক্যানসার। ডিম্বাশয়ে গ্র্যানুলোসা সেল টিউমার হলে বেশিমাত্রায় ইস্ট্রোজেন হরমোন নিঃসরণ হওয়ার জন্য হরমোনজনিত কারণে রক্তস্রাব হয়।
* ইস্ট্রোজেন হরমোন থেরাপি : ইস্ট্রোজেন হরমোন খেলে বা ইস্ট্রোজেন মলম লাগালে এরকম ঋতুস্রাব হতে পারে।* ডি.ইউ.বি রোগ : স্ত্রী হরমোন ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরোন নিঃসরণের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার জন্য। * হাইপাস প্লাসটিক বা এন্ডোমেট্রিয়াম।
* সংক্রমণজনিত কারণ : যোনির সংক্রমণ যথা ট্রায়কোমোনিওসিস ও মেনিলিয়া সংক্রমণ, এড্রোমেট্রিয়ামের যক্ষা।
* বার্ধক্যজনিত কারণ * জরায়ুর পলিপ * সার্ভিক্সে ঘা অথবা পলিপ।
* আঘাতজনিত কারণ : সরাসরি আঘাত, ডেকুবিটাস আলসা, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি যথা-কপার-টি, মাল্টিলোড কপার ইত্যাদি জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত থাকলে। * মূত্রনালীর পলিপ, ক্যানসার, ক্যারাংকল ইত্যাদি।
* শরীরের সাধারণ রোগ : যেমন- রক্তের রোগ, অতিরিক্ত উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি। * ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কোন কারণ জানা যায় না।
কারণ অনুসন্ধান : প্রথমত সুনিশ্চিত হওয়া দরকার যে উক্ত রক্তস্রাব কোন পথ দিয়ে দিচ্ছে। যোনি দিয়ে, গুহ্যদ্বার দিয়ে না প্রস্রাবের পথ দিয়ে। সেইজন্য দরকার বিস্তারিতভাবে ইতিহাস নেওয়া।
যে যে বিষয়ে জেনে নেওয়া হয় :
* রজোনিবৃত্তির বয়স। * রজোনিবৃত্তির পূর্বে মাসিকের ধরণ। * রক্তস্রাবের পরিমাণ। * যোনি দিয়ে কোন কিছু বের হয়ে আসছে এ ধরনের কোন উপসর্গ।
* প্রস্রাবের সমস্যা যথা প্রস্রাবের সময় ব্যথা ও ঘনঘন প্রস্রাব পাওয়া। * ইস্ট্রোজেন হরমোন সেবন করার ইতিহাস।
* পরিবারের কারো এন্ডোমেট্রিয়ামের ক্যানসার হওয়া ইত্যাদি।
সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা : অত্যধিক মেদবহুল স্বাস্থ্য ও উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে এন্ডোমেট্রিয়ামের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তলপেট ফুলে থাকলে তা জরায়ুর ক্যানসার বা ডিম্বাশয়ের টিউমারের জন্য হতে পারে। জরায়ুর স্থানচ্যুতির জন্য সার্ভিক্স বহিঃপ্রজনন অঙ্গের বাইরে থাকতে পারে এবং এতে ঘা ও থাকতে পারে। বহিঃপ্রজনন অঙ্গে কোন ঘা বা টিউমার আছে কিনা তাও ভালো করে লক্ষ্য করা হয়। যন্ত্রপাতি দিয়ে জরায়ুর মুখ ও যোনি পরীক্ষা করা হয়। কোন টিউমার থাকলে তা থেকে বায়োপসি নেওয়া হয়। কোন টিউমার না থাকলেও সার্ভিক্স বা যোনি নিঃসৃত কোষ পরীক্ষা করা হয়।
বিশেষ অনুসন্ধান : যে যে পরীক্ষা সচরাচর করা হয় তা হল :
* প্রস্রাব পরীক্ষা করা, আলট্রাসনোগ্রাফী, যোনি, সার্ভিক্স ও এন্ডোমেট্রিয়ামের কোষ পরীক্ষা করা। * রোগীর ডিসি ও সার্ভিক্সের বায়োপসি করা।
* হিসটোরোস্কোপি করে পুনমূল্যায়ন। * ল্যাপারোস্কোপি- যে ক্ষেত্রে ডিম্বাশয় বা অ্যাডনেক্সাল ম্যাস সন্দেহ করা হয়।
হোমিওপ্যাথিক প্রতিবিধান : মেনোপজের পর ঋতুস্রাব নিরাময়ে হোমিওপ্যাথিতে ফলদায়ক ওষুধ আছে। নির্দিষ্ট মাত্রায় লক্ষণ সাদৃশ্যে নিম্নলিখিত ওষুধ ব্যবহৃত হয়। যথাÑ ১) আর্সেনিক ২) এপিস ৩) অরাম মেট ৪) ল্যাকেসিস ৫) অরাম মিউর ন্যাট্রো ৬) কোনিয়াম ৭) ক্রিয়োজোট ৮) গ্রাফাইটিস ৯) আর্স আয়োড ১০) কার্বো এনি ১১) কার্বোভেজ ১৩) সিপিয়া ১৪) সিকেলি ১৫) লাইকোপোডিয়াম ১৬) আয়োডিয়াম ১৭) ফাইটোলাক্কা ১৮) প্ল্যাটিনা ১৯) এসিড নাইট ২০) মার্কুরিয়াস ২১) হাইড্রাসটিস ২২) ক্যালকেরিয়া ২৩) ফসফরাস ২৪) থুজা ২৫) পালসেটিলা ২৬) হেমামেলিস ২৭) অস্টিলেগো ২৮) এমিল নাইট্রেট ২৯) কার্সিনোমাসিনাম ৩০) সালফার উল্লেখযোগ্য। তারপরেও চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করা উচিত।
লেখক : হোমিও চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক