মহিমাময় মহররম মাসের ফজিলত-মর্যাদা-আমল

2

ফখরুল ইসলাম নোমানী

ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। ইসলামের ইতিহাসে এই মাস এমন কতগুলো উল্লেখযোগ্য ও স্মৃতিবিজড়িত যে স্মৃতিসমূহের সম্মানার্থেই এই মাসকে মহররম বা সম্মানিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হাদিস শরিফে চান্দ্রবর্ষের ১২ মাসের মধ্যে মুহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। চান্দ্রবর্ষের প্রথম মাসটির পুরো নাম হলো ‘মুহররামুল হারাম। পবিত্র মহররম একটি তাৎপর্যমন্ডিত এবং বরকতময় মাস।
আশুরা অর্থ দশম। মহররম মাসের ১০ তারিখ আশুরা নামে খ্যাত। আশুরাতেই নভোমন্ডলে সৃষ্টিকুলের প্রাথমিক বিভাজন প্রক্রিয়ার সূচনা হয়। হজরত আদম (আ.) এর সৃষ্টি, স্থিতি, উত্থান ও অবনমন—সব ঘটনাই ঘটেছিল আশুরায়। হজরত নুহ (আ.) এর নৌযানের যাত্রারম্ভ ও বন্যাবস্থার সমাপ্তি ছিল আশুরাকেন্দ্রিক। হজরত মুসা আলাইহিস সাল্লামের সমুদ্রপথের ধাবমান রওনা ও এর তাওয়াক্কুল যাত্রায় যে সময় বেছে নেওয়া হয়েছিল তা ছিল আশুরা। এ ধারাবাহিকতায় আল্লাহর রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনার কথা আশুরার সময়ে বা আশুরাকেন্দ্রিক হতে পারে বলে আশা ও আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। এ সময় এলেই তিনি বিনম্র থাকতেন, রোজা রাখতেন। কোরআন কারিমে রয়েছে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর নিকট মাসের সংখ্যা বারো তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। (সুরা-৯ : তাওবা : আয়াত : ৩৬)। হাদিস শরিফে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত সুরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চার মাস বলতে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব এই চার মাসকে বোঝানো হয়েছে।
মহররম মাসের করণীয় আমলসমূহ হলো : চাঁদের প্রথম রাতে ও দিনে নফল নামাজ। প্রথম ১০ দিন নফল রোজা। বিশেষত ৯ ও ১০ মহররম আশুরার সুন্নাত রোজা। আশুরার দিনে ও রাতে নফল ইবাদত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেন রমজানের রোজার পরে মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ যেমন ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের নামাজ অর্থাৎ তাহাজ্জুদ নামাজ সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন। ইসলামের বিধানে তওবা-ইস্তেগফার যেকোনো সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। কোনো পাপের কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা অথবা ভুলত্রুটি করলেই শুধু তওবা-ইস্তেগফার করবে এমন নয়। বান্দা সর্বদা আল্লাহর দরবারে ধরনা দেবে এবং নিজের অতীতের জন্য ক্ষমা চাইবে। তবে কিছু কিছু মুহূর্ত এমন রয়েছে যখন তওবার পরিবেশ আরও অনুকূল হয়। বান্দার উচিত আল্লাহর দেওয়া সেই প্রত্যাশিত মুহূর্তগুলো লুফে নেওয়া এবং আল্লাহমুখী হয়ে জীবনকে আরও সুন্দর করা। মহররম মাস বিশেষ করে এর ১০ তারিখ ‘ইয়াওমে আশুরা’ এমনই একটি উপযুক্ত সময়। মহররম মাসের ফজিলতের একটি দিক হচ্ছে এর সঙ্গে তওবা কবুল হওয়া এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে মুক্তি নিরাপত্তা এবং গায়েবি সাহায্য লাভ করার ইতিহাস জুড়ে আছে। এজন্য এ সময় এমন সব আমলের প্রতি মনোনিবেশ করা উচিত যাতে আল্লাহর রহমত বান্দার প্রতি আরও বেশি ধাবিত হয়। আশুরার দিন রোজা রাখা সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আল্লাহ পাকের নিকট আমি আশাবাদী যে তিনি এক বছর আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। রাসুল (সা.) আরও বলেন রমজানের রোজার পর মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ যেমন ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের তাহাজ্জত নামাজ সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন। প্রাক-ইসলামি যুগেও মহররমের ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল। অফুরন্ত বরকত ও তাৎপর্যমতি মহররম মাসে বহু নবী-রাসুল ইমানের কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে মুক্তি ও নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। কারবালাসহ অসংখ্য তথ্যবহুল ঐতিহাসিক ঘটনা এ মাসে সংঘটিত হয়েছিল।

আশুরার তাৎপর্য : মহররম মাসের ১০ তারিখকেই আশুরা বলা হয়। নি:সন্দেহে আশুরার দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার দিন। এ দিনটি মুসলিম উম্মাহকে পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ দিনেই ঘটেছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয় বিদরাক ও মর্মান্তিক কারবালা ঐতিহাসিক ঘটনা। এক কথায় এ দিনটি দ্বীন প্রতিষ্ঠায় হিজরত এবং হক তথা উত্তম প্রতিষ্ঠার জন্য এক সুমহান দিন। এ কারণেই মুসলিম উম্মাহ এ দিনটিকে বিশেষ ইবাদাত-বন্দেগি তথা রোজা পালনের দিন হিসেবে শ্রদ্ধা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালন করে থাকে। মহররম মাসের ১০ তারিখ আশুরার দিনটি হজরত মুসা আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গী-সাথীদের জন্য বিজয়ের দিন হলেও এ দিনেই ঘটেছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয় বিদরাক ও মর্মান্তিক কারবালা ঐতিহাসিক ঘটনা। আল্লাহর জমিনে দ্বীন তথা উত্তম প্রতিষ্ঠায় ইসলামের অগ্রসেনানী হজরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ আত্মত্যাগ এক মহাঅনুপ্রেরণা। পবিত্র মহররম আশুরা ও কারবালা এ তিনটি শব্দ যেন একে অন্যের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে একটি যৌগ দর্শন সৃষ্টি করেছে। মহররম-পবিত্রতা, মর্যাদা, সম্মান ও সুনাম-সুখ্যাতির প্রতীক। আশুরা পূর্ণতা প্রাপ্তি ও সফলতার প্রতীক ; কারবালা-বিপদাপদ বালামুসিবত ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রতীক। মহররম ও আশুরার শিক্ষা ও তাৎপর্যকে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত চিরভাস্বর করে রাখবে কারবালার শহীদদের অবদান। রাসুলে করিম (সা.) বলেন আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী আল্লাহ তাআলা এর অসিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। রাসুল (সা.) আরও বলেন রমজানের রোজার পর মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ যেমন ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের তাহাজ্জত নামাজ সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন। উম্মুল মুমিনিন হজরত হাফসা (রা.) বলেন রাসুলে আকরাম (সা.) চারটি কাজ জীবনে কখনো পরিত্যাগ করেননি। আশুরার রোজা, জিলহজের প্রথম দশকের রোজা, আইয়ামে বিদের রোজা, ফজর ওয়াক্তে ফরজের আগে দুই রাকআত সুন্নত নামাজ। পূর্বে মুসলমানদের জন্য আশুরার রোজা ফরজ ছিল। দ্বিতীয় হিজরিতে শাবান মাসে রমজানের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা সুন্নত হয়ে যায়। তবে সুন্নত রোজার মধ্যে আশুরার রোজা সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ। আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন আশুরার দিনে রোজার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট আমি আশাবাদী তিনি পূর্বের এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।

কারবালার চেতনা : হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর ফোরাতের তীরে কারবালার প্রান্তরে আত্মদান মূলত অসত্য, অসুন্দর, অন্যায় ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে সত্য–সুন্দর–ন্যায় ও কল্যাণের অনন্তকালের জন্য আদর্শিক বিজয়ের চেতনা। কারবালার চেতনা অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেতনা। মহররম মাস আসবে প্রতিবছর ঘুরে, আশুরা আসবে বারবার ঘুরেফিরে, কারবালার চেতনা জাগ্রত হবে প্রতিটি সংকট মুহূর্তে। মহানবী (সা.) বলেন জালিম শাসকের সম্মুখে হক কথা বলা উত্তম জিহাদ।
তাই আসুন আল্লাহর দরবারে বিনীত প্রার্থনা করি তিনি যেন মহররম মাসের ইসলামি ঐতিহ্য, গুরুত্ব ও মর্যাদা অনুধাবন করে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অশেষ সওয়াব হাসিলের তাওফিক দান করেন এবং ঐতিহাসিক কারবালার মর্মস্পর্শী ঘটনা স্মরণে প্রতিটি মুসলমানকে ইমানি চেতনা শক্তিতে বলীয়ান ও তেজোদীপ্ত হওয়ার মানসিকতা দান করেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র মহররম ও আশুরা থেকে আমাদের অফুরন্ত ফজিলত দান করুন। আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট