সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে তাঁর বান্দাদের জন্যে বছরের কিছু মাসকে বিশেষভাবে সম্মানিত ও মর্যাদাবান করেছেন। সেই মর্যাদাশীল মাসসমূহে বান্দা নেক আমল করলে তার মর্যাদা ও সম্মানও আল্লাহ তাআলার নিকট বৃদ্ধি পায়। এ মাসগুলোর মধ্যে বিশেষ ফযীলত ও মর্যাদাপূর্ণ মাস হলো- মাহে শা’বান। এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল বরাতের মতো একটি অত্যন্ত বরকতময় রজনী। এ মাসে বান্দার সারা বৎসরের আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয় এবং আগামী এক বৎসরের জন্য বান্দার হায়াত, মউত, রিয্ক, দৌলত ইত্যাদির নতুন বাজেট দেয়া হয়।
অন্যদিকে মাহে শা’বান রমযানের পূর্বের মাস হওয়ার কারণে মূলত এটি মাহে রমযানের সাধনা ও অধ্যবসায়ের পূর্ব-প্রস্তুতির মাস। তাই তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসকে স্বীয় মাস হিসেবে আখ্যায়িত কওে এরশাদ করেন- “শা’বান আমারই মাস, এ মাসের শ্রেষ্ঠত্ব অপরাপর মাসগুলির উপর তেমন, যেমন আমার শ্রেষ্ঠত্ব সমস্ত মাখলুকের উপর।” [আল মাক্বাসিদ আল হাসানা, হাদীস নং-৫৭১] তিনি আরো ইরশাদ করেন: ‘রজব আল্লাহর মাস, শা’বান আমার মাস এবং রমযান আমার উম্মতের মাস।’ [আল মাক্বাসিদ আল হাসানা, হাদীস নং-৭০৬]
শা’বান মাসকে রমযান মাসের প্রস্তুতি ও সোপান হিসেবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে একটি বিশেষ দোয়া করতেন এবং অন্যদের তা শিক্ষা দিতেন। মাহে রমযানকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে আল্লাহর কাছে অধিক হারে এই বলে প্রার্থনা করতেন যে, “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবিওঁ ওয়া শা’বান ওয়া বাল্লিগনা রামাদ্বান।” ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে রজব ও শা’বান মাসে বিশেষ বরকত দান করুন এবং আমাদের রমযান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন।’ (মুসনাদে আহমাদ-২৩৪৬, বায়হাকি-৩৫৩৪, জামে সগির- ৫/১৩১ ও তবারানি-৩৯৩৯, ৬/২৬৯)
নবীজির এ দোয়ার মাধ্যমে সবার কাছে শা’বান মাসের ফযিলত প্রতীয়মান হয়। তাই মাহে রমযানের পূর্বে আমাদের প্রথম কাজ হলো রমযানকে পাওয়ার জন্যে মহান আল্লাহর দরবারে বারবারে দোয়া করা, যেন আল্লাহ হায়াত দীর্ঘ করে আমাদেরকে মাহে রমযানে পৌঁছে দেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, “মাহে রজব ও রমাদান শরিফের মধ্যবর্তী এমন এক মাস রয়েছে, যার মর্যাদা সম্পর্কে মানুষের জানা নেই।” [নাসায়ী, হা-২৩৫৭, আহমদ, হা-২১২৪৬]
এ মাসের ফযিলতকে মানুষ উপেক্ষা করে। মাসটি রজব ও রমযানের মধ্যবর্তী মাস হওয়ার ফলে এর মাধ্যমে মূলত বুঝানো হচ্ছে শা’বান মাসকে। যেহেতু দুটি সম্মানিত মাস বেষ্টন করে রেখেছে, সে জন্য মানুষ ওই দুই মাসের আমলে ব্যস্ত হয়ে শা’বান মাসকে অবহেলা করে।
যখন শা’বান মাস উপস্থিত হতো তখন হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, “এ মাসে তোমরা তোমাদের অন্তরকে পাক-পবিত্র করে নাও এবং নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নাও।”[তবারানি-৫০৪]
এ মাসে আল্লাহর অপরিমেয় রহমত ও করুণার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, যাতে বান্দাগণ স্বীয় গুনাহ ক্ষমা করিয়ে নিতে পারে। বিশেষত: এ মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত ‘শবে বরাত’ হিসেবে পরিচিত।
এ মাসকে কেন শা’বান মাস নামে নামকরণ করা হয়েছে : “লিসানুল আরব” নামক কিতাবে রয়েছে- শা’বানকে এ নামে অভিহিত করার কারণ হলো, কেননা আরবরা এ মাসে কল্যাণের সন্ধানে ছড়িয়ে পড়তো। ছা’লব বলেন, কেননা এ মাসটি দু’টি বরকতময় মাস তথা রজব ও রমযান মাসের মধ্যবর্তী একটি শাখা। (ইবন মনযুর: লিসানুল আরব, ১/৫০১)
শা’বান মাসের রোযার ফযিলত: মাহে রমযানের প্রস্তুতিকল্পে ইসলামে শা’বান মাসকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। মাহে রমযানে দীর্ঘ ৩০টি রোযাপালনের কঠিন কর্মসাধনা সহজ ও নির্বিঘেœ আদায় করার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে শা’বান মাসের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় মাসের একটি হলো শা’বান। এ মাসে নফল রোযা আদায় করেই তিনি মাহে রমযানের রোযাপালন করতেন।’ [আবু দাউদ-২৪৩১]।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে আরয করা হলো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার কাছে মাহে রমযানের পর কোন্ মাসের রোযা উত্তম?’ তিনি বললেন, ‘রমযান মাসের সম্মান প্রদর্শনকল্পে শাবানের রোযা উত্তম।’ [তিরমিযি- হা-৬৬৩]
হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বলেন, শাবানের তুলনায় অন্য কোন মাসে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এত অধিক হারে রোযা পালন করতে দেখিনি। তিনি শাবানের প্রায় পুরোটাই রোযায় অতিবাহিত করতেন। কিছু অংশ ব্যতীত তিনি পুরো শা’বান মাস রোযা রাখতেন।[মুসলিম- ১১৫৬]।
অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, “শা’বান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত অধিক হারে নফল রোযা আদায় করতেন না।”[বুখারি- হা: ১৮৬৮]
তিনি আরও বলেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ধারাবাহিকভাবে এতো বেশী নফল রোযা রাখতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম তিনি হয়তো আর (নফল) রোযা ছাড়বেন না, আবার কখনও এতো বেশী (নফল) রোযা থেকে বিরত থাকতেন যে, আমরা বলতাম তিনি হয়তো আর রোযা (নফল) রাখবেন না। তাই আমরা তাঁকে রমযান মাস ছাড়া আর অন্য কোন মাসে পূর্ণ মাস রোযা রাখতে দেখিনি এবং যে মাসে সর্বাধিক নফল রোযা রাখতেন তা হলো শা’বান মাস।[বুখারী-১৮৬৮, মুসলিম-১১৫৬]
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের নিকট আরয করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! শা’বান মাসের ন্যায় অন্য কোন মাসে আপনাকে এতোবেশী (নফল) রোযা রাখতে কখনও দেখি না কেন? উত্তরে তিনি এরশাদ করেন, “শা’বান এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস যার সম্পর্কে অনেক মানুষ অনবগত-উদাসীন, যেটি রজব ও রমযানের মধ্যবর্তী মাস, এটি ওই মহান মাস যে মাসে বান্দার আমলনামা রব্বুল আলামীনের দরবারে সরাসরি পেশ করা হয়। তাই আমি চাই আল্লাহর দরবারে আমার আমলসমূহকে এ অবস্থায় উঠানো হোক যে, আমি রোযাদার। (নাসায়ী-২৩৫৭)
হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বলেন, প্রিয় নবীর অধিকাংশ রোযা ছিল শা’বান মাসে। তখন আমি তাঁর দরবারে আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি দেখছি আপনার অধিকাংশ রোযা রাখা হয় শা’বান মাসে, তার কারণ কি? হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ মাসে যাদের ইন্তিকাল হবে তাদের নামের তালিকা ‘মালাকুল মাওত’ এর কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাই আমি চাইনা আমার নাম লিপিবদ্ধ হোক আমি রোযাদার থাকা ব্যতিরেকে (অর্থাৎ আমার রোযা অবস্থায়ই আমার নাম লিপিবদ্ধ হোক-সেটাই আমি কামনা করি)। (ইমাম ইবন রাজব হাম্বলী: লাত্বায়েফুল মা’য়ারেফ,১/১৩৩)
শা’বান মাসের রোযার উপকারিতা : ফরয রোযার তুলনায় এ সব রোযার স্থান ফরয নামাযের আগে-পরে সুন্নাতের অনুরূপ। এ সুন্নাতগুলো যেমনিভাবে ফরয নামাজগুলোর অসম্পূর্ণতাকে পরিপূর্ণতা দান করে, ঠিক তেমনিভাবে রমযানের আগে-পরে নফল রোযাগুলোও রমযানের রোযাগুলোর নানা অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দান করে।
নামাযের আগে-পরে সুন্নাত যেমন অন্যান্য সাধারণ নফল হতে শ্রেষ্ঠ তেমনিভাবে রমযান মাসের আগে-পরের রোযা অন্য সময়ের নফল রোযা হতে শ্রেষ্ঠ। তাই ফরয নামাযের পূর্বে ও পরের সুন্নতের অনুরূপ শা’বান মাসের কয়েকটি রোযা এবং শাওয়াল মাসের ছয় রোযা পালন করা সুন্নত।
এমনিভাবে শা’বানে রোযা রাখার দ্বারা অন্য উপকারও আছে। তা হল; শাবানে রোযাপালনের মাধ্যমে রমযান মাসের রোযাপালনের অনুশীলন হয়। এতে রমযান মাসে রোযাপালনে কষ্ট অনুভব হয় না; বরং এর মাধ্যমে রোযা রাখার অনুশীলন ও অভ্যাস সৃষ্টি হয়। ফলে রমযান মাসে রোযাপালনে উৎসাহ ও আনন্দ বৃদ্ধি পায়।
এ মাসের ইবাদত ও আমলের বিশেষ ফযীলত :
শা’বান মাসকে এত বেশি গুরুত্ব দেওয়ার বিশেষ কারণ হলো, এ মাসে শবে বরাত নামে বিশেষ একটি রজনী আছে, যে রজনীতে বান্দার সারা বছরের আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয় এবং আগামী এক বছরের জন্য বান্দার হায়াত, মউত, রিয্ক, দৌলত ইত্যাদির নতুন বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এ মাসে মুসলমানদের আমল-আখলাক যেন সুন্দর হয়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। শা’বান মাসে ভারসাম্যপূর্ণ নেক আমলের তাগিদ দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা তোমাদের সাধ্যানুযায়ী আমল করবে, কেননা আল্লাহর কাছে প্রিয় আমল তা-ই যা নিয়মিত পালন করা হয়।” [বুখারি-৬১০০]
তাই মুসলমানদের উচিত মাহে রমযানের পূর্বে কিছু রোযা রাখার অভ্যাস করা, যাতে করে মাহে রমযানের রোযাপালন সহজ হয় এবং লক্ষ্যও ঠিক মতো অর্জিত হয়। পাশাপাশি যতটুকু সম্ভব পরম করুণাময় আল্লাহর অশেষ দয়া ও ক্ষমার দৃষ্টি লাভের আশায় শা’বান মাসব্যাপী রাতগুলোতে জাগ্রত থেকে অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগি করা, কোরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা ইত্যাদি করা। বিশেষত: এ মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে তথা শবে বরাতে তওবা-ইস্তেগফার করে অতীতের সব গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুমহান আদর্শ অনুসরণে নিজেদের জীবন পরিচালনার দৃঢ় প্রত্যয় ও শপথ গ্রহণ করা উচিত।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ