উত্তম কুমার চক্রবর্ত্তী
দেবীপক্ষের সূচনা পূর্বের আমবস্যাটি হলো মহালয়া। এটি আমাদের পূর্ব পুরুষদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের ধারণাটি যেমন যুগ যুগ ধরে প্রতিষ্ঠিত করেছে ঠিক তেমনি আনন্দময়ী বিশ্বজননী দেবী দুর্গার আগমনী বার্তাও প্রেরণ করেছে বারে বারে। মহালয়া সমাপনান্তে শুরু হয় দেবীপক্ষ। কৈলাস শিকড় থেকে পরমেশ্বরী মহামায়া দেবীদুর্গার আগমনী বার্তায় ধরণী হয় মুখরিত। শরতের আকাশে হাসির নির্মল ছটা আর শ্বেত শুভ্র মেঘমালার আনাগোনায় মনে হয় সাদা বকের সারি উড়ন্ত ডানা মেলে চলছে দিক হতে দিগন্তে। প্রিয় ঋতুর বিচিত্র সৌন্দর্য্য যেন চির যৌবনা হয়ে ধরা দেয় মাতৃভক্তদের হৃদয়ে। কাক ডাকা ভোরের শিউলী তলায় শিশির স্নাত শুভ্রফুলের বিছানার অপূর্ব শোভায় প্রত্যেকের প্রাণে মাতৃবন্দনার উদ্বোধন রচিত হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতির মধুর পরশে মুগ্ধ হয়ে শারদ লক্ষীকে আহবান জানিয়েছেন তাঁর অমর সৃষ্টি কবিতার ছন্দে:
‘নবীন ধানের মঞ্জুরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা
এসো গো শারদলক্ষী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে-।’
শরতের মহালয়ার এই শুভ সময়ে একদিকে তর্পণ শ্রাদ্ধের মাধ্যমে প্রয়াত আত্মার শান্তি কামনা অন্যদিকে মনোরম প্রকৃতির অনিন্দ্য রূপ লাবণ্যের বরণঢালা মাথায় নিয়ে বাঙালি ভক্তরা আয়োজন করে দুর্গতিনাশিনী কল্যাণময়ী মাকে বরণের। মর্ত্যে আসবেন মা তাই চারিদিকে সাজ সাজ রব। ভোরের আকাশে ভেসে আসে চন্ডীপাঠের সুমধুর আওয়াজ। মাঙ্গলিক আয়োজনের অপূর্ব সমাহারে ভরে যায় মাতৃমন্দির, বারোওয়ারী বাড়ি, ভক্তগৃহ ও পূজামন্ডপ। দেবীদুর্গা যে আমাদের ঘরের মেয়ে, আমাদের মা এমনটি অনুভব করতে পারলেই মাতৃপূজার প্রতিটি আয়োজন হবে সার্থকমন্ডিত। জগতে মাতৃভক্তদের সার্থক প্রতিনিধি সাধক রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, বামাক্ষ্যাপা ও শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বিশ্বজননী দেবীকে তাঁদের নিজেদের মায়ের মত করে হৃদয়ে আসন দিয়েছেন বলেই জগৎময়ী মা তাঁদের নিকট জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছিলেন। বিশ্বমূর্তি মহাদেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমায় প্রকৃত মাকে উপলব্ধি করতে পারলেই মাতৃসাধকদের মতো আমরাও দেবীপক্ষে দৃঢ় প্রত্যয়ে সকলকে বলতে পারবো:
‘এবার আমার ঊমা এলো
আর ঊমাকে পাঠাবো না,
বলে বলুক লাখো মন্দ,
কারো কথা শুনবো না।’
বিশ্বজননী মা আসছেন দেবীপক্ষে। তাই বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন মঠ-মন্দির এবং মিশনে চন্ডীর ঘট বসিয়ে মাতৃপূজা শুরু হয় এবং মহাসপ্তমী থেকে হয় প্রতিমায়। তবে বেশিরভাগ পূজামন্ডপে ষষ্টাদিকল্পে বোধন, আমন্ত্রণ এবং অধিবাসের মাধ্যমে পুজা শুরু হয়ে দশমীতে বিজয়া উৎসব পালিত হয়। এছাড়াও মহালয়া পরবর্তী প্রতিপদ থেকে নব দুর্গাপুজাও অনুষ্ঠিত হয় কোন কোন অঞ্চলে। আর দশমীতে হয় দশেরা উৎসব। ত্রিভুবন জননী মহাদেবী দুর্গার নয়টি রূপ মিলে হলো নবদুর্গা। দেবীপক্ষের সূচনালগ্নে নবদুর্গার তাত্ত্বিক দিক নিয়ে আলোচনা করতে চাই। শক্তিশাস্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ শ্রীশ্রী চন্ডীর দেবী কবচে মায়ের নয়টি রূপের উল্লেখ রয়েছে। নবদুর্গার প্রথম রূপ শৈলপুত্রী। দেবীপক্ষের শুরুতে শুক্লা প্রতিপদে মায়ের এই রূপের পূজা করা হয়। মাতৃসাধনার এই পর্যায়ে প্রাণায়াম ক্রিয়ার দ্বারা সাধক তাঁর কুন্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করেন এবং মূলাধারচক্রে স্থিত হন। তাইতো বলতে বাসনা জাগে:
‘কুন্ডলিনী শক্তি বায়বী আকারে
অচৈতন্যভাবে আছেন মূলাধারে
গুরুদত্ত কর্ম সাধনের জোড়ে,
চেতন কর না তারে।’
শুরু হয় মনের অসুরত্ব বিনাশের সাধনা। শুভশক্তির বিজয় ঘটিয়ে পরিশুদ্ধ মনের বৃহৎ কুটস্থ তথা মহান আলয়ে যাত্রার নিরন্তর প্রচেষ্টা। দ্বিতীয় দিনে মা ব্রহ্মচারিনী রূপে পূজিতা। এটি জগৎময়ী মা দুর্গার দ্বিতীয় প্রকাশ। মাতৃ কৃপায় সাধক হয়ে উঠেন প্রায় বিষয়াসক্তি শূন্য। বাসনা তার মাটির বাসনের মতো ভেঙ্গে চুরমার হতে থাকে এবং স্বাধিষ্ঠান চক্রে তার মনের ঊর্ধ্বায়ন ঘটে। নবদুর্গার তৃতীয় রূপ হলো মা চন্দ্রঘণ্টা। তৃতীয়াতে হয় তাঁর পূজা। মায়ের হাতে থাকে ঘণ্টা যার নিনাদে সুমধুর ওঁকার ধ্বনি বেরিয়ে আসে। সে ধ্বনি দেহস্থ ষড়রিপু সদৃশ আসুরিক শক্তিসমূহের ত্রাস সঞ্চারকারী। তাই মাতৃবন্দনার এ পর্যায়ে সাধক মনের রিপু সমূহ অবদমিত করে মণিপুরেই তাঁর মনকে স্থিত করেন। কৃপাময়ী মায়ের চতুর্থ রূপ কুস্মন্ডা। দেবীপক্ষের চতুর্থীতে হয় তাঁর পুজা। মায়াময় সংসারের ত্রিবিধ তাপ হরণ করে দেবী সাধকের সাধনক্রিয়ায় সহযোগিতা করেন। ফলে যোগসাধনায় সাধকের মন অনাহতচক্রে অবস্থান করে। যোগ ছাড়া সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা কঠিন। সবার জীবনে যোগ দরকার। মাতৃপূজার প্রতিদিনের আয়োজনে সাধকের কুন্ডলিনী শক্তির পর্যায়ক্রমিক ঊর্ধ্বায়ন ঘটতে তাকে এবং একসময় সাধক পৌঁছে যান ব্রহ্মানন্দের পরম সুখরাজ্যে। নবদুর্গার পঞ্চম রূপ হলো স্কন্দমাতা। পঞ্চমীতে হয় তাঁর পূজা। ভক্তের নিকট তিনি বাঞ্ছাকল্পতরু। পঞ্চম দিনের সাধনায় সাধকের চিত্তবৃত্তি একেবারেই লোপ পায় এবং তাঁর মন ধাবিত হয় বিশুদ্ধ চৈতন্যময় স্বরূপের দিকে। এই যেন বিশুদ্ধচক্রে মনের তিথিহীন অবস্থা। তখন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মতো সাধক অনুভব করেন “আমি মায়ের আর মা আমার।” নবদুর্গার ষষ্ঠ রূপ হলো দেবী কাত্যায়নী। ষষ্ঠী তিথিতে এই নামেই তিনি পুজিতা হন। মাতৃপূজার ষষ্ঠ দিনে সাধক তার সর্বস্ব মাতৃচরণে সমর্পণ করেন। মন স্থিত হয় ভ্রুমধ্যে আজ্ঞাচক্রে। দেবীর মহাজ্যোতির অমৃত আলোয় দেহপুর আনন্দপুরীতে রূপান্তরিত হয়। পার্থিক সুখ সম্পদের আকাক্সক্ষার পরিপূর্ণ বিলোপ হয়ে সাধক ছুটে যান পরমাত্মবিদ্যার সুগভীর আনন্দ সাগরে। দেবীর সপ্তম রূপ হলো কালরাত্রি। মহাসপ্তমীতে হয় তার পূজা। মহাকালের ক্রিয়াকে যিনি কলন করেন তিনিই তো কালরাত্রি। সাধনার সপ্তম দিবসে সাধক পরম শক্তির অধিকারী হন এবং তার মনের অবস্থান হয় সহস্রারে। ঊর্ধ্বলোকের পরম সত্তায় সাধক একাকার হয়ে যান। এ যেন জীবাত্মিকা শক্তির সাথে পরমাত্মিকা শক্তি মিলেমিশে একাকার। এ স্তরে মহাকালের কলনক্রিয়া হয় সাধকের ইচ্ছাধীন। নবদুর্গার অষ্টম রূপ হলো মহাগৌরী। মহাঅষ্টমীতে দেবী সেই নামে পুজিতা। সাধনরাজ্যের অষ্টম দিনে সাধক অমৃতময়ীর অমৃততত্ত্বেই সর্বক্ষণ স্থিত থাকেন। জীব আর ব্রহ্মে অভেদ জ্ঞানের সুবর্ণ বিভায় সাধক বিচরণ করেন ত্রিভুবন জননীর যন্ত্রীরূপে। নবদুর্গার নবম রূপ হলো দেবী সিদ্ধিধাত্রী। দেবীপক্ষের নবম দিনে হয় তাঁর পুজা। সাধকের নিকট তিনি মুক্তিধাত্রী ও পরম শান্তিপ্রদায়িনী। দিব্য আলয়ে স্থিত সাধককে মা সাধন সমরে বিজয়ী হওয়ায় আশির্বাদ প্রদান করেন। বিজয়ের সিদ্ধি যেন সাধকের অনুভবে। দেবী বন্দনার দশম দিবসের দশমীতে চারিদিকে আনন্দের বারতা-শুভ বিজয়া। এভাবে মহালয়া পরবর্তী দেবীপক্ষের প্রতিপদ থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত পূজার প্রতিটি আয়োজন স্বাত্তি¡কভাবে সুসম্পন্ন করে দেবী বন্দনায় মাতৃসাধকদের মতো আমরাও জীবনের আসুরিক শক্তিসমূহ পদদলিত করে শুভশক্তির বিজয় সুসম্পন্ন করতে পারি। তখনই বিজয়াদশমী আমাদের নিকট পরিণত হবে বিজয় উৎসবে। জীবন হবে আনন্দময়, প্রেমময় ও সুখদায়ক। রচিত হবে হিংসা, রিরংসামুক্ত মৈত্রীময় সমাজ। প্রতিটি পরিবার হবে মানবিক গুণসম্পন্ন সুখী পরিবার। পরিশেষে ত্রিভুবন জননী কৃপাময়ী মায়ের নিকট প্রার্থনা! হে অনন্তজ্যোতি মা, তুমি অভয়হস্তে আমাদেরকে উজ্জ্বল চৈতন্য দান করো যাতে করে আমরা জাতিতে-জাতিতে, ধর্মে-বর্ণে সুমহান সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করতে পারি এবং বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকলে মিলেমিশে কাজ করতে পারি। জয় মা।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, ধর্মীয় বক্তা ও প্রাবন্ধিক
উত্তম কুমার চক্রবর্ত্তী