এ কে এম আবু ইউসুফ
শ্রমজীবীদের কথা উঠে আসতেই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার এই পঙক্তিগুলো যেন কানে বেজে ওঠে: “প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,/ চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য/ কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।/ চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,/ গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,/ তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য/ জীবনকে চায় ভালবাসতে।’’ কবিতার লাইনগুলো শ্রমজিবী মানুষদের প্রতি ভালবাসার বহি:প্রকাশ আরা আজ সেই বিশেষ দিন, যে দিনটা প্রত্যেক বছর পালিত হয় শুধুই শ্রমিকদের দিন হিসেবে। তাঁদের সারা বছর কাটে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। একটি দিন সেই কাজ থেকে ছুটির দিন। বলছিলাম মে দিবসের কথা। দিনটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের রক্ত ঝরা দিন। প্রতি বছর সারা বিশ্বে এই দিনটি পালিত হয় প্রতীকী দিন হিসেবে। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষদের দিন হিসেবে। মে দিবস হাজার হাজার শ্রমিকের পথ চলা মিছিলের কথা, একই পতাকা তলে দাঁড়িয়ে আপোষহীন সংগ্রামের কথা। মে দিবস দুনিয়ার সব শ্রমিকদের এক হওয়ার দিন।
আন্তর্জাতিক সংগ্রাম আর সৌভ্রাতৃত্বের দিন। মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের কাছে জাগরণের গান, সংগ্রামের ঐক্য ও গভীর প্রেরণা। সে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের মূল দাবি ছিল ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা। ওই কর্মসূচির অংশ হিসেবে সেদিন ৩ লাখ শ্রমিক এক ঐতিহাসিক ধর্মঘটে শামিল হয়েছিল। আর ২ মে ছিল রোববার এবং ৩ মে আরও বড় শ্রমিক সমাবেশে মালিকের গুন্ডারা আক্রমণ চালিয়ে ৬ জন শ্রমিককে হত্যা করেছিল। এর প্রতিবাদে ৪ মে শহরের হে মার্কেট স্কোয়ারের বিশাল সমাবেশে মালিক ও সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর নির্বিচার লাঠিচার্জ ও গুলিতে শ্রমিকের রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল হে মার্কেট চত্বর। নিহত হয়েছিল ৪ জন শ্রমিক। কয়েকজন পুলিশও প্রাণ হারিয়েছিল। ৮ জন শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৫ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। বস্তুতপক্ষে আমেরিকার শ্রমিকদের এই আন্দোলনের সমর্থনে দেশে দেশে শ্রমিকরা সংহতি আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে মালিকরা বাধ্য হয়ে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি মেনে নিতে শুরু করে আর ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকী উপলক্ষে ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের নেতৃত্বে প্যারিসে দ্বিতীয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছরই সোস্যালিস্ট লেবার ইন্টারন্যাশনালের সম্মেলনে জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিনের ঘোষণা অনুযায়ী ১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর ১ মে ‘মে দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এভাবেই আন্তর্জাতিকভাবে মে দিবস পালনের সূচনা হয়। অর্থাৎ মে দিবসের সামগ্রিক ইতিহাস শুরু থেকেই শ্রমিক শ্রেনীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তি অর্জন ও আন্তর্জাতিক সংহতির লক্ষ্যে ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাস। এটি কখনোই নিছক কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। মে দিবসকে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দি করার অর্থই হলো শ্রমিক শ্রেণিকে তার মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত করার প্রচেষ্টা। শ্রমিক শ্রেনীর কাছে মে দিবস হলো নতুন সংগ্রামে উজ্জীবিত হওয়ার শপথের দিন। কারণ সংগ্রাম ছাড়া আর কোনো পথে শ্রমিকের পক্ষে তার ন্যায্য দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। কিন্ত মে দিবস পালনে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার এই আপেক্ষিক মুক্ত পরিবেশ তৈরি হলেও লাখো শহীদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার মতোই ‘মে দিবসের মুক্তি’ও এ দেশে হোঁচট খেয়েছে। এ দেশের শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনগণকে আবার শোষণ-বঞ্চনা-অধিকারহীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে বস্তুত বিতাড়িত হয়েছে মেহনতি মানুষের মুক্তির প্রশ্নটি। শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়ন থেকে মুক্ত হয়ে প্রতিটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও আজ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এটা অনস্বীকার্য যে, শ্রমিকশ্রেণী যেকোনো দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা শুধু উৎপাদন ব্যবস্থারই প্রধান শক্তি নন, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনেরও অন্যতম কারিগর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বে এখনও শ্রমিকদের নানামুখী বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি প্রদান, সময়মতো বেতন-ভাতা প্রদানসহ তাদের সঙ্গে ভালো আচরণের ব্যাপারে রয়েছে অন্তহীন অভিযোগ। ন্যায্য পাওনা আদায়ে মালিকের দ্বারে দ্বারে ঘোরা এমনকি আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার চিত্রও এখানে কম নয়। এটা সত্য যে, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে দেশে শ্রমিকদের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। তাদের জন্য ন্যায়সঙ্গত করণীয় আরও অনেক কিছু বাকি। অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার পথে অগ্রসর হতে ১৯৭২-এর সংবিধানে ‘সমাজতন্ত্র’কে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অন্যতম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু হত্যা, ষড়যন্ত্র, অন্তর্ঘাত ইত্যাদি চালিয়ে দেশকে অল্প সময়ের মধ্যে সে ধারা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণি ও জনগণের অধিকার ও কর্তৃত্ব স্বীকার করা হলেও আজ পর্যন্ত তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং জনগণের সম্পদ ও উৎপাদনব্যবস্থার কর্তৃত্ব চলে গেছে লুটেরা শ্রেণির হাতে। আর সংবিধানে এখনো এসব নির্দেশনা বহাল থাকলেও তথাকথিত মুক্তবাজার নীতির নামে ‘উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টনপ্রণালি’র মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ ‘দেশের জনগণের’ হাত থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। অসংখ্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে তা তুলে দেওয়া হয়েছে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে। ‘কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশের’ ওপর এখনো চলছে নানামাত্রিক শোষণ-নিপীড়ন। ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে শ্রমিকদের। নারী শ্রমিকদের ওপর চলছে অধিকতর বঞ্চনা ও বৈষম্য। শ্রমিক শ্রেণির অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হলেও তা মানা হচ্ছে না। অনেক বেসরকারি শিল্প-কারখানায় আইএলও নির্ধারিত শ্রমঘণ্টাও মানা হয় না। দেশে শ্রমিক শ্রেণী শুধু ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত নয়, অনেক ক্ষেত্রে তাদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণও বটে। আগুনে পুড়ে ও ভবন ধসে প্রায়ই মরতে হয় তাদের। এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে তাদের জীবন ও শ্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মে দিবসে শ্রমিক শ্রেণির মানবেতর জীবনের অবসান ঘটানোর অঙ্গীকার করতে হবে আমাদের সবাইকে। বিশ্বায়নের যুগে উদারীকরণ নীতি শ্রমিক স্বার্থে আঘাত হানছে বলে বিভিন্ন মহলের জোরালো মত রয়েছে।
মে দিবসে এসব বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের। সবচেয়ে যা জরুরি তা হল, শ্রমের মর্যাদা নিশ্চিত করা। শ্রমিক শ্রেণি সামাজিকভাবে মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি এখনও। অথচ কাজ কাজই, তা যে প্রকৃতিরই হোক না কেন। মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ ও দৈহিক কাজের মধ্যে পার্থক্য করা সভ্যতাপরিপন্থী। সমাজের অন্যান্য পেশার মানুষের মতো শ্রমিকদের একটি মর্যাদাসম্পন্ন শ্রেণি হিসেবেই দেখা উচিত আমাদের। ধনিক শ্রেণি ও শিল্পগোষ্ঠীর প্রতি আহবান যে কোন পরিস্থিতিতে শ্রমিকের পাশে দাঁড়ান আর তা হলে দেশকে এগিয়ে নিতে তারা সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। তবেই এই মানুষগুলো আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন। সমাজ দাঁড়াতে পারবে। মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে উঠবে। শ্রমদিবসের লড়াইও সার্থক হবে। দেশের সব শ্রমজীবী মানুষের প্রতি অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গণমাধ্যম কর্মী, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ( বাপউস)