দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে হারিয়ে গেছে ডেঙ্গু পরিস্থিতির খবর। মানুষের দৃষ্টি যখন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তখন ডেঙ্গু তার ভয়াহ রূপ নিয়ে মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এ ভয়াহ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ে কারো যেন কোন মাথাব্যথা নেই। স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন সিটি কর্পোরেশন এবং স্বাস্থ্য বিভাগের নানা উদ্যোগের কথা শুনা গেলেও সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম ও পরিচ্ছন্ন অভিযানসহ স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগগুলো দৃশ্যমান নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চলতি সপ্তাহে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ৬৭ জন মৃত্যুবরণ করেছে। সেইসাথে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে আরো প্রায় সাড়ে ছয় হাজার রোগী। এ অবস্থায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে যে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন তাও দেখা যাচ্ছে না। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দুটিতেই এখন প্রশাসক। দেশের সবকটি সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার নির্বাচিত মেয়র কাউন্সিলরগণ জুলাই বিপ্লবের পর গা ঢাকা দেয়ায় সরকার সর্বশেষ সকল মেয়র অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করেন। চট্টগ্রামেও প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে ২০২১ সালের নির্বাচনে সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বিপক্ষে নির্বাচন করে ডা. শাহাদাত হোসেন পরাজিত হলে তিনি নির্বাচনে বড়ধরনের কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচনী ট্রাইবুন্যালে মামলা করেন। দীর্ঘ শুনানীর পর রেজাউল করিম অপসারণ হলে ট্রাইব্যুনাল কারচুপির সত্যতা পেয়ে ডা. শাহাদাতকে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন। গেজেট প্রকাশ ও শপথের পর গত ৫ নভেম্বর ডা. শাহাদাত হোসেন চট্টগ্রাম সিটির মেয়রের দায়িত্ব নেন। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পরপরই ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি এলাকায় মশক নিধন কার্যক্রম ও পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম জোরদার করেন। পাশাপাশি চসিক পরিচালিত মেমন জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফ্রি সেল প্রতিষ্ঠা করেন। একইসাথে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলছেন। মেয়র শাহাদাতের এসব উদ্যোগ স্বল্প সময়ে নগরবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রাম, সফল হলে সারা দেশের জন্য তা মডেল হতে পারে। মেয়র শাহাদাত অবশ্যই মশার ওষুধে কোনরকম ভেজাল সহ্য করা হবেনা বলে সংশ্লিষ্টদের হুশিয়ার করেছেন। আমরা আশাকরি, এ উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। তবে চিন্তার বিষয় হচ্ছে, শীতকাল বা শুষ্ক মৌসুমে ডেঙ্গু মশার উপদ্রব কম থাকে। এখন নভেম্বর শেষ হতে চলেছে, শীতের আগমনী বার্তাও পেয়ে গেছি আমরা। অর্থাৎ বৃষ্টিপাত নেই। সেক্ষেত্রে ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করল কীভাবে? প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। গত বুধবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে শনিবারে মৃত্যু হয়েছিল ১১ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮৬ হাজার ৭৯১। আর মৃতের সংখ্যা ৪৫৯। এ নভেম্বরে ২৩ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ২৪,৯৭৪ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ১৪৪ জন। উপরের তথ্যগুলো যে বাস্তবতা নির্দেশ করছে, এর বিপরীতে করণীয় কী? প্রথমত, এডিস মশার প্রজনন, এর আচরণ এবং জীবনধারায় কী কী পরিবর্তন এসেছে, সে সম্পর্কে গবেষণা জরুরি হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, এ মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তৃতীয়ত, ডেঙ্গু আক্রান্তদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। কথা হচ্ছে, এ তিন কাজের কোনোটাই কি আমরা সুচারুরূপে পালন করছি? নতুন ধারণা পাওয়া গেছে, এডিস মশা শুধু পরিষ্কার পানিতে নয়, দূষিত পানি, এমনকি নোনা পানিতেও বেঁচে থাকতে সক্ষম। রাতের বেলায়ও সংক্রমণ ঘটাতে পারে এ মশা। এমন অবস্থায় এডিস মশা নির্মূল করার কোনো বিকল্প নেই। অথচ এ ব্যাপারে আমরা তেমন তৎপরতা লক্ষ করছি না। বস্তুত, আমাদের স্বাস্থ্য খাতের তেমন কোনো উন্নতি ঘটাতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে বড় ধরনের কোনো অভিযোগ নেই অবশ্য। কিন্তু ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার কেন ঘটছে, তা নির্ণয় করে প্রতিরোধের কোনো কার্যক্রম আমাদের চোখে পড়ছে না। আমরা এ বিষয়টিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দেওয়ার আহবান জানাই। সাধারণ মানুষের প্রতি আমাদের পরামর্শ থাকবে, জ্বর হলেই যেন তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। প্রকৃতপক্ষে, মানুষ যত সচেতন হবে, এ রোগের প্রকোপ ততই কমে যাবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ডেঙ্গুর ভয়াবহতা থেকে মুক্ত হবে দেশ-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।