মরহুম এম.এ সালাম : একটি জীবন একটি ইতিহাস

3

এম ওসমান গণি

প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক দেশে কিছু কিছু ক্ষণজন্মা পুরুষের আবির্ভাব হয়, যারা কেবল নিজের জন্য বাঁচে না। তারা হয় পরোপকারী, মানব দরদী। তখন তারা সাধারণ মানুষের গন্ডী পেরিয়ে হয়ে ওঠেন অসাধারণ। এ সব কীর্তিমান পুরুষ তখন নিজের পাড়া, মহল্লা তথা জেলার সীমানা অতিক্রম করে হয়ে ওঠেন দেশ নেতা, জাতীয় ব্যক্তিত্ব। তেমনি একজন মহান ব্যক্তি হচ্ছেন চট্টলার কৃতি সন্তান মরহুম এম. এ সালাম। আলহাজ্ব এম.এ সালাম ১৯৩৮ সালের ১৩ আগষ্ট ডবলমুরিং থানার অন্তর্গত পৈতৃক নিবাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলহাজ্ব আবদুর রহমান এবং মাতার নাম আলহাজ্ব আছিয়া খাতুন। বাবা পেশায় একজন কন্ট্রাক্টর এবং মাতা ছিলেন গৃহিণী। পিতা-মাতার ১১ সন্তানের মধ্যে এম. এ সালাম ৯ম সন্তান। ১১ জনের মধ্যে ভাইয়ের সংখ্যা ৮ ও বোন ৩ জন। তার পিতৃদত্ত পূর্ণ নাম মোহাম্মদ আবদুস সালাম হলেও তিনি এম. এ. সালাম বা সালাম সাহেব নামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর পূর্ব পুরুষের আদি নিবাস ছিল হাটহাজারীতে এবং মহাকবি আলাওল তাঁর অন্যতম পূর্ব পুরুষ। মোগল আমলে আগ্রাবাদ মুহুরীপাড়ায় এসে তাঁর পূর্ব পুরুষগণ বসতি স্থাপন করেন। স্থানীয় মক্তবে এম. এ. সালামের লেখাপড়ার হাতেখড়ি। স্থানীয় প্রাইমারী স্কুল, বারিক মিয়া হাইস্কুল ও বেগমজান হাইস্কুলে তিনি লেখাপড়া করেন। ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিক পাশ করার পর চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন চট্টগ্রাম কলেজ থেকেই। পরে তিনি আইসিএস থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমা করেন। বলা বাহুল্য, পিতার পেশাগত অভিজ্ঞতা, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা ও প্রখর মেধা পরবর্তীকালে কর্মজীবনে তাঁকে দেয় সাচ্ছন্দ্য ও দক্ষতা। যে কোন নির্মাণ কাজে তার দক্ষতা ও নির্ভুল সিদ্ধান্ত সর্বজন স্বীকৃত। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৬২ সালে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পপতি মরহুম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ্য কন্যা নূরজাহান বেগমের সাথে। ১৯৬২ সাল থেকে শুরু করে আমৃত্যু তথা ২০০২ সাল পর্যন্ত তাঁদের দাম্পত্য জীবনের এই সুদীর্ঘ ৪০ বছর ছিল অতি সুখের ও শান্তির। তিনি বলেন “আমরা সুখী পরিবার”। এম. এ সালামের পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে। এম. এ সালাম ও তার গুণবতী স্ত্রী উভয়েই আদর্শ পিতা-মাতা, উভয়েই ছেলে মেয়েদের সু-শিক্ষা ও উত্তম চরিত্র গঠনে ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান ও সচেতন। তাঁর জবানীতেই শোনা যাক তাঁর সন্তানদের যোগ্যতা।“ আমার পাঁচ ছেলে, দুই মেয়ে। সবাই সুশিক্ষিত, মেয়েগুলো মাস্টার্স পড়ছে। ছেলেগুলো দেশে-বিদেশে লেখাপড়া শিখেছে। তিন ছেলে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বড় ছেলে হাসান সালাম সেলিম। সে ইস্টার্ন স্ট্রবোর্ড এন্ড পেপার মিলস লি. এর এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর। চট্টগ্রামে আমার গার্মেন্টস ব্যবসা আছে যা মেজো ছেলে দেখাশোনা করে। আমার বায়িং হাউস আছে। আমরা মাছ রপ্তানি করি। এটা আমার চতুর্থ ছেলে দেখাশোনা করে। এখন আমরা হাউজিং ব্যবসা শুরু করেছি। আমার তৃতীয় ছেলে আমেরিকা থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। সে প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট ব্যবসা দেখাশোনা করে। ছোট ছেলে আইন বিষয়ে লেখাপড়া করছে। তাকেও ব্যবসায় নিয়ে আসব। আমরা সুখী পরিবার।”
সাবেক পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পীকার প্রখ্যাত রাজনীতিক শহীদে মিল্লাত মরহুম ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দীক্ষা গুরু। তিনি যোগদান করলেন মুসলিম লীগে। সেই থেকে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, ভাঙ্গা-গড়া, দল বদলের হিড়িকের মধ্যেও তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন অকৃত্রিম মুসলিম লীগার। স্থানীয় পর্যায়ে একজন সাধারণ সদস্য পদ থেকে নানা পদ ও পথের বাধা ডিঙ্গিয়ে পার্টির আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা ও যোগ্যতার গুণে তিনি ক্রমে আসীন হন কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সভাপতির আসনে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে। তাঁর রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল মানুষের কল্যাণ ও জনসেবা। লাভ তো দূরের কথা নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে দলের আদর্শকে সদা সমুন্নত রাখার এমন দৃষ্টান্ত এই যুগে নজিরবিহীন, সন্দেহ নেই। তার এই নির্লোভ ও নির্মোহ গুণ তাঁকে দল-মত নির্বিশেষে সকল রাজনীতি সচেতন মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে তার মরণোত্তরকালে সপ্রমাণিত হয় যে তিনি কত বড় সজ্জন ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন। মরহুম এম. এ সালাম ১৯৭০, ১৯৭৯ ও ১৯৮৬ সালে নিজ দলের প্রার্থী হিসাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। দলের প্রতি আনুগত্য না থাকলে দল বদলের তাবিজ পরে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার সুবর্ণ সুযোগের মায়াবী হাতছানিতে তিনিও হয়তো সাড়া দিতেন। নিঃস্বার্থ জনগণের সেবক আদর্শ রাজনীতিক সালাম সাহেবকে কোন লোভ লালসা কখনও এতটুকু বিভ্রান্ত করতে পারেনি। যুগে যুগে জয় হোক এমনি আদর্শ নেতার। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর মুসলিম লীগের কার্যক্রম অনেকটা স্তিমিত হলেও অনেক বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বাধীন এই ঐতিহ্যবাহী দলের ইমেজ অস্বীকার করা যায় না। সক্রিয় রাজনীতিতে অতোখানি তৎপর না থাকলেও জাতীয় যে কোন সংকটময় অবস্থায় এই পার্টির বর্ষীয়ান নেতাদের পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা গুরুত্ব পেতে দেখা যায়। প্রধানতঃ কনস্ট্রাকশনসহ বহুবিধ ব্যবসা ছিল তার পারিবারিক পেশা ও ঐতিহ্য। তাঁর পিতা আলহাজ্ব আবদুর রহমান কন্ট্রাক্টর সফল ব্যবসার মাধ্যমে অর্জন করেন প্রভূত সম্পদ ও অর্থ। অগাধ ভূ-সম্পত্তি ও বিত্ত বৈভবের অধিকারী এই পারিবারিক ঐতিহ্য ধারা থেকে তিনিও ছিলেন না বিছিন্ন। তাই কেবল একজন রাজনীতিবিদ নন, একজন সফল ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি হিসাবেও তিনি সর্বমহলে পরিচিত। আপন সীমাবদ্ধ পুঁজি নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বহু শিল্প কারখানা। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। দৃঢ় মনোবল ও অসম সাহস ছিল তাঁর সকল মহাপরিকল্পনার পাথেয়। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ও সম্প্রসারিত একাধিক ব্রিক ফিল্ড ব্যতিরেকে তার স্থাপিত শিল্প কারখানার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ ঢাকাস্থ ইস্টার্ন স্ট্রবোর্ড এন্ড পেপার মিলস লিমিটেড, পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লি. এবং চট্টগ্রামস্থ সেলিম এন্ড ব্রাদার্স লি প্রগ্রেসিভ ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লি. ইন্টারন্যাশনাল ফ্রোজেন লি., এ আর প্রপাটি ডেভেলপমেন্ট (প্রা.) লি. ইত্যাদি। তাঁর সঠিক নির্দেশনার ফলশ্রুতিতে তাঁর সুযোগ্য তিন ছেলের পরিচালনায় প্রত্যেকটি সংস্থার গুণ মান, কলেবর ক্রমশঃ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত। তাঁর মেজো ছেলে মামুন সালাম পোষাক শিল্পের এক সুযোগ্য পরিচালক হিসাবে আন্তর্জাতিক মহলেও একটি সুপরিচিত নাম। আন্তর্জাতিক সম্মাননা পদকও তিনি অর্জন করেন। রাজনীতি ও ব্যবসা মরহুম এম. এ সালামের পেশা হলেও তাঁর প্রকৃত নেশা ছিল আপামর জনগণের কল্যাণ সাধন। এখানেই সত্যিকার সালাম সাহেবের পরিচয়। তাঁর ভাষায়, ছোট বেলা থেকে আমি সামাজিক কাজে অভ্যস্থ। রাজনীতি করছি, ব্যবসা করছি।
বন্দর নগরী চট্টগ্রামের এমন কোন মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, বেসরকারি স্কুল-কলেজ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নেই যেখানে তাঁর দানের হস্ত প্রসারিত হয়নি সামান্যতম হলেও। কখনো কখনো আলাপ প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, ‘দেখুন আমার তেমন ক্যাশ টাকা নেই, তবু যতদূর তওফিকে কুলায় সাহায্য করতে চেষ্টা করি।” বলা বাহুল্য সমসাময়িককালে চট্টগ্রামে সালাম সাহেবের চেয়ে অর্থ বিত্তের অধিকারী লোকের কমতি নেই, কিন্তু বিত্তের চেয়ে চিত্তের মহত্ত¡ থাকা লোকের সংখ্যা খুবই কম। তাঁর অর্থানূকূল্যে, বিজ্ঞ পরামর্শে, সক্রিয় সহযোগিতা ও পরিচালনায় প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএসটিসি), পাহাড়তলী কলেজ, সিলভার বেলস কিন্ডারগার্টেন এন্ড হাই স্কুল এবং আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ ইত্যাদি। ইউএসটিসি’র জন্মলগ্ন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জমি দাতা (২.২৫ একর) সিন্ডিকেট সদস্য, উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে এবং নানা সমস্যা সংকট নিরসনে সাহসী এবং ফলপ্রসু ভূমিকা ও অবদানের মূল্যায়নে ইউএসটিসির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসা বিজ্ঞানী জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলামের দু’টি মূল্যবান বাক্যই যথেষ্ট। তা হলো, “ তিনি (এম. এ সালাম) ইউএসটিসির অমর কীর্তি। বস্তুত জনাব এম. এ সালাম শুধু ইউএসটিসি’র অমর কীর্তি নয়, তিনি তার চেয়েও মহৎ”। ইউএসটিসি’র এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদসহ হাজারো সুধী সমাবেশে জাতীয় অধ্যাপকের স্বীকৃতি বিশেষ তাৎপর্যবহ। বলা যায়, জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম ইউএসটিসির স্বপ্ন দ্রষ্টা ও পরিকল্পক, আর এম. এ সালাম তার সার্থক ও সফল রূপকার। পাহাড়তলী কলেজের উপযোজন মঞ্জুরীর লক্ষ্যে আরোপিত শর্ত পূরণের অবশ্য প্রয়োজনে সদাশয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ইজারা প্রদত্ত তিন একর জমিতে একটি ভবন নির্মাণের জন্য মরহুম এম. এ সালামের দানকৃত ৫৪ হাজার ইট এবং বিদ্যোৎসাহী মরহুম আলহাজ্ব এয়াকুব আলী কন্ট্রাক্টরের ১৮০ বস্তা সিমেন্টসহ তিন হাজার নদগ টাকার গুরত্ব অপরিসীম। শুধু নির্মাণ সামগ্রী দান নয়, ১৯৭৬ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২৬ বছর তিনি পাহাড়তলী কলেজ পরিচালনা পরিষদের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। কলেজটি তাঁর অতি প্রিয়। মরহুম এম. এ সালাম ছিলেন খাঁটি ঈমানদার ব্যক্তি। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়সহ অন্যান্য ধর্মীয় কর্তব্য পালনে ছিলেন তিনি সদা সচেষ্ট। পবিত্র রমজান মাসের ২৭ তারিখ গরিব-দুঃখী, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে ইফতার ও খানার দাওয়াত দেওয়া ছিল তাঁর বাৎসরিক রেওয়াজ। তার অর্থানুকুল্যে একাধিক মসজিদ পরিচালিত।
চট্টলার গৌরব এই মহান পুরুষ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভারতের মুম্বাই নগরীর জাসলক হাসপাতালে ২০০২ সালের ১৯ নভেম্বর মোতাবেক ১৩ রমযান ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন এটাই আমাদের প্রার্থনা।

তথ্য সূত্র: মরহুম এম. এ সালাম স্মারক গ্রন্থ