লিটন দাশ গুপ্ত
‘ম’ হলো বাংলা বর্ণমালার ছত্রিশতম বর্ণ, যার ইংরেজি প্রতিবর্ণ এম (গ)। এই ‘ম’ বর্ণের সাথে কার চিহ্ন যুক্ত হয়ে বাংলাতে ‘মা’ শব্দটি সৃষ্টি হয়েছে। আর এই মা শব্দটিতে কি বৈচিত্রময় আশ্চর্য ক্ষমতা আছে জানিনা, মাকে ডাকলে মনপ্রাণ ভরে উছলে পড়ে অদৃশ্য মমতার সুধাধারা। আবার ‘ম’ বর্ণে আরো বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীর অধিকাংশ জাতি তাদের মাতৃভাষায় মা-কে ডাকে বাংলা ‘ম’ বা ইংরেজি ‘এম’ বর্ণটির ধ্বনিগত উচ্চারণের মাধ্যমে। যেমন- ইংরেজিতে ‘মাদার’; ভিয়েতনামে ‘মে’; গ্রীক ভাষায় ‘মানা’; ল্যাটিন ভাষায় ‘মাতের’; ফরাসি ভাষায় ‘মেরে’; ব্রাজিলে ‘মাএ’; ডেনমার্কে ‘মোর’; হিন্দি ভাষায় ‘মাতাজি’; আরবিতে ‘আম্মি’; আফ্রিকায় ‘মোয়েদের’। এই রকম আরো অনেক অনেক ভাষায় মা-কে ডাকতে গেলে ‘ম’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়। এখানে দেখা যায় বিভিন্ন দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির বাধা অতিক্রম করে ‘ম’ বর্ণটি হয়ে উঠেছে সার্বজনীন ও বিশ্বজনীন। সত্যিকার অর্থে মাতৃত্ব হচ্ছে একজন নারীর চিরন্তন রূপ। সন্তান জন্মের মাধ্যমে নারী জাতির মাতৃত্বের পূর্ণতা লাভ করে। সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে মা ও সন্তানের একান্ত বন্ধন বিদ্যমান। এই বিদ্যমান বন্ধনের মাধ্যমে রচিত হয়েছে ¯েœহ মায়ামমতা ভরা প্রকৃত ভালোবাসার এক চুড়ান্ত ইতিহাস। যার ফলে আদিম যুগে সন্তান যখন খাবারের সন্ধানে বনজঙ্গলে শিকারে বের হত, তখন হিংস্রজন্তুর আক্রমণে সন্তান আক্রান্ত হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে মা উৎকন্ঠায় থাকত। উদাস মনে পথপানে চেয়ে থাকত সন্তান কখন নিরাপদে কুঁড়েঘরে ফিরবে! এখন আধুনিক যুগে সন্তান আর বনজঙ্গলে যায়না; যায় শিক্ষালয়ে বা জীবন জীবিকার সন্ধানে। সেই মা এখনো উদ্বিগ্ন চিন্তায় থাকে পথেঘাটে কোনপ্রকার বিপদআপদ বা দুর্ঘটনায় পড়ছে কিনা! এখনো মা পথের দিকে আকুল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কখন সন্তান নিরাপদে বাড়ি ফিরবে। যাইহোক মমতাময়ী মায়ের মমতার কথা বলেই শেষ হবে না। তবে আজ মাতৃস্নেহের দুটি ঘরোয়া দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে লেখা শেষ করব।
প্রথমটি হচ্ছে- আমার ঠাকুরমাকে নিয়ে। ঠাকুরমা ছিলেন অত্যন্ত সহজ সরল শান্তস্বভাবের এক নারী। জীবন সায়াহ্নে বলতে গেলে একেবারে হুঁশহীন ছিলেন। বার্ধক্যজনিত কারণে বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এই অবস্থায় আমার বাবা যেদিন বাংলাদেশ রেলওয়ের চাকুরী জীবনের শেষ স্বাক্ষর করে অবসরে আসেন, সেদিন ঘরে এসে তাঁর মাকে (আমার পিতামহী) বলেন, ‘মা তোমার আশীর্বাদ নিয়ে আমার ৩৭ বছর চাকুরী জীবন সুন্দরভাবে সুসম্পন্ন করে, আজ থেকে অবসরে এলাম। কাল থেকে আর কোন দিন চাকুরীতে যেতে হবেনা’। তখন আমার ঠাকুরমা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলেন, ‘অবুক! তইলে তুই চলিবি ক্যানেরে, আঁই মরণর সমত আঁরে চিন্তায় ফেলারিরে…’ ! মৃত্যুর শয্যায় থেকেও সন্তানের জন্যে মায়ের এই আকুতি প্রকৃতিগত মা-সন্তানের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বলা যায়। এইতো গেল ঠাকুরমার মাতৃত্বের দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি বলব আমার মা-কে নিয়ে। আমার মা ‘সিএলডি’র কারণে লিভারের মারাত্মক সমস্যায় ভুগছিলেন। একাধিক বার রিং পরানো হয়েছিল। শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেও মানসিক দৃঢ়তার কারণে মোটামুটি সুস্থ মনে হত। এই অবস্থায় এক শীতের সন্ধ্যায় মা-সহ পরিবারের সবাই বসে হাসি ঠাট্টায় কথাবার্তায় মত্ত ছিলাম। হঠাৎ দেখি মায়ের মুখ দিয়ে প্রচুর রক্ত বের হচ্ছে। আমরা গাড়ি করে নগরীর একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। যাবার পথেও গলা দিয়ে কয়েক লিটার রক্ত ও বমি বের হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তারপরেও মা গাড়িতে নিজের চাদরটা জোর করে আমার গায়ে মুড়িয়ে দিয়ে দিচ্ছে আমার ঠান্ডা লাগবে বলে। হাসপাতালে যারা দেখতে আসে, তাদের সবাইতে মা শুধু একটা কথায় বলেছিল, ‘আমার ছেলেকে দেখবি’। ক্লিনিকের কেবিনে আনুষ্ঠানিক চিকিৎসা শেষে গভীর রাতে যখন আইসিইউ-তে নিতে হল, তখন আমিও প্রবেশ করলাম। এটাই আমার মায়ের সাথে শেষ দেখা।
এই সময় আমার মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে, ‘আমার জন্যে কান্নাকাটি করিস না, আর কোন চিন্তা করবিনা, ভালো মত চলিস, আমি ওপারে চলে যাচ্ছি’! সুস্থ সবল সুস্পষ্ট কথা, তাই তখনও বুঝে উঠতে পারিনি এটাই মায়ের শেষ দেখা, শেষ কথা। পুুরো রাত উৎকন্ঠায় ছিলাম। মাঝে মধ্যে চিকিৎসক থেকে খবর নিচ্ছি, ডাক্তার সাহেব বলছে কিছুটা উন্নতি বা ভালোর দিকে! আমরা সবাই সকালে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে ঢাকা নেবার পরিকল্পনা করছি। কিন্তু সকাল ১০:১৫ মিনিটে চিকিৎসক এসে জানায় মা আর নাই। অথচ মা পরলোকে যাবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত কতই চিন্তা করে গেছে আমার জন্যে। মমতাময়ী মা-কে নিয়ে এই রকম আরো বাস্তব হাজারো দৃষ্টান্ত রয়েছে, যা বলেই শেষ হবেনা। তাই মায়াবতী মা হচ্ছেন সন্তানের জন্যে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা অমূল্য শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যাঁর সাথে আর কোন সম্পত্তি বা অন্য কোন কিছুর সাথে তুলনা হয়না। পরিশেষে আমার মাকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাই, মা তুমি যেখানে থাকো ভালো থেকো। সৃষ্টিকর্তা যাতে বৈকুন্ঠধামে তোমাকে সর্বোচ্চ প্রশান্তির জায়গায় রাখে।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক