মব জাস্টিস : ন্যায়বিচারের ছদ্মবেশে নৈরাজ্য

2

মোহাম্মদ মোরশেদ

মব জাস্টিস অর্থ হলো উত্তেজিত ও ক্ষুব্ধ জনতার একটি অংশ কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে সাধারণত কোনো অপরাধের সন্দেহে নিজ হাতে শাস্তি প্রদান, যা প্রায়ই গুরুতর শারীরিক আঘাত বা মৃত্যুর রূপ নেয়। এটি জনরোষের উন্মুক্ত বিস্ফোরণ হলেও ন্যায়বিচারের পথ নয়। বরং এটি একটি ভয়ানক অপরাধপ্রবণ প্রবণতা, যা আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা করে। যখন জনগণ বিচারপ্রক্রিয়ায় আস্থা হারায়, তখন তারা Hobbes-এর বর্ণিত ‘প্রাক-রাষ্ট্রীয়’ অরাজক অবস্থায় ফিরে যায়, যেখানে আইন নয়, শক্তিই হয়ে ওঠে একমাত্র নির্ণায়ক। গণপিটুনির মাধ্যমে ‘ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠার এই প্রবণতা আদতে একটি বিচারবহির্ভূত ও বর্বর সংস্কৃতির জন্ম দেয়। এটি এমন এক বর্বরতা যা যুক্তি ও মানবিকতা থেকে বিচ্যুত, এবং এর ফলে বহু নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারায় যা একটি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন।
বাংলাদেশে বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল। মামলার নিষ্পত্তিতে চলে যায় বছরের পর বছর। ফলে সাধারণ মানুষ অনেক সময় মনে করে, “নিজের হাতে বিচার”-ই কার্যকর উপায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুলিশ ঘটনাস্থলে দেরিতে পৌঁছে বা যথাযথ পদক্ষেপ নেয় না। এই বিলম্ব বা নিষ্ক্রিয়তা জনতাকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে উৎসাহিত করে। জন রলস তার A Theory of Justice-এ ‘ন্যায়ের দুই নীতি’ ব্যাখ্যা করেন প্রথমত, সকলের সমান স্বাধীনতা নিশ্চিত করা; দ্বিতীয়ত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো এমনভাবে বণ্টন করা, যাতে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া শ্রেণিও উপকৃত হয়। রলস মনে করতেন, যদি রাষ্ট্র এই নীতি কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সমাজে ‘বিকল্প ন্যায়ের’ (alternative justice) প্রবণতা তৈরি হয় যেটি প্রায়ই হয় সহিংস, অবিচারপূর্ণ ও জনআস্থা ধ্বংসকারী। মব জাস্টিস ঠিক তেমনই এক ভয়াবহ বিকল্প যা বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ হলেও, শেষ পর্যন্ত তা সকলের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্মে যাচাইবিহীন ভিডিও বা পোস্ট দ্রæত ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে গুজব ও অপপ্রচারের মাধ্যমে সহিংসতা উসকে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা এবং মানবিক মূল্যবোধের অভাব সমস্যাটিকে আরও তীব্র করে তোলে। সন্দেহজনক কোনো পরিস্থিতিতে পুলিশের সহায়তা চাওয়ার বদলে জনতা নিজেরাই ‘শাস্তি’ দিতে উদ্যত হয়। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও সামাজিক বৈষম্য মানুষের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভকে জন্ম দেয়। কোনো ছোট ঘটনা এই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। জনতা যখন একত্র হয়, তখন ব্যক্তি-পর্যায়ের যুক্তিবোধ অনেক সময় লোপ পায়। একজন শুরু করলে বাকিরাও আবেগে কিংবা উসকানিতে পিটাতে শুরু করে। হেগেল রাষ্ট্রকে নৈতিকতার সর্বোচ্চ প্রকাশ হিসেবে দেখতেন, এবং তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘ন্যায় কেবলমাত্র তখনই বাস্তবায়িত হয়, যখন তা যুক্তিনির্ভর এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে আসে।’ মব জাস্টিসের মধ্যে যুক্তি, মানবিকতা বা প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার কোনো উপাদান নেই। এটি ন্যায় নয়, বরং ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে। এতে নিরপরাধ মানুষ আক্রান্ত হয়, এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও গভীর হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে গণপিটুনির ঘটনা বেড়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এর পেছনে রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিরোধেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলে ভিন্নমত দমনে প্রতিপক্ষকে ‘চোর’, ‘ধর্ষক’, ‘জঙ্গি’ বা ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত করে জনরোষের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভাজনের ফলে সামাজিক উত্তেজনা বাড়ছে। বিভাজনের এই পরিবেশে সন্দেহের ভিত্তিতে মানুষকে টার্গেট করে মব গঠনের প্রবণতাও বেড়েছে। আমাদের সমাজে গণপিটুনি কোনো হঠাৎ সৃষ্ট সমস্যা নয়। এটি বিচারহীনতার দীর্ঘ দিনের ফল। মানুষ যখন দেখে অপরাধ করে কেউ ধরা পড়ে না, বা ধরা পড়লেও বিচারপ্রক্রিয়া বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, তখন তারা রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা হারায় এবং নিজেরাই ‘বিচারক’ হয়ে ওঠে। সমাজতাত্তি¡করা এই অবস্থাকে বলেন “substitution of justice” যেখানে রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতা সমাজ নিজেই পূরণ করতে চায়। জন লক তার সমাজচুক্তি তত্তে¡ বলেন, রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি রক্ষা করা। যখন রাষ্ট্র এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তখন জনগণ রাষ্ট্রের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তবে লক স্পষ্টভাবে বলেন, ব্যক্তিগত প্রতিশোধ বা গোষ্ঠীগত বিচার কোনো ন্যায়ের রূপ নয়, বরং তা রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে ফেলে। মব জাস্টিস সেই অস্থির পরিস্থিতিরই পরিণতি যেখানে ন্যায়বিচার নয়, বরং ক্রোধ ও গুজব হয়ে ওঠে নীতির মানদন্ড। কিন্তু এই পরিস্থিতি অপরাধ দমন করে না, বরং আরও নতুন অপরাধ তৈরি করে। কারণ গণপিটুনিতে কোনো যাচাই-বাছাই থাকে না। শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে নির্দোষ মানুষও ‘অপরাধী’ হয়ে যায়। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত শত্রুতা, গুজব, বিভ্রান্তি সবকিছু এই সহিংসতার পেছনে ভূমিকা রাখে। আমরা অতীতেও দেখেছি, ফেসবুকে ‘শিশু চোর’ সন্দেহে ছড়িয়ে পড়া গুজবের কারণে নিরীহ মানুষদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনাগুলো শুধু মানবিক বিপর্যয় নয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যর্থতারও প্রতিচ্ছবি।
রেনু হত্যাকান্ড বাংলাদেশের গণপিটুনির সবচেয়ে আলোচিত ও মর্মান্তিক ঘটনাগুলোর একটি। তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘শিশু ধরার’ গুজব পুরো দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। ২০১৯ সালে ২০ জুলাই। তাসলিমা বেগম রেনু, রাজধানীর উত্তর বাড্ডার একটি স্কুলে গিয়েছিলেন তার মেয়েকে ভর্তি করানোর খোঁজখবর নিতে। সে সময় এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, “শিশু অপহরণকারী চক্র” সক্রিয়, এবং একজন মহিলা অপহরণ করতে এসেছে। এই ভিত্তিহীন গুজবে উত্তেজিত জনতা তাকে স্কুলের ভেতরেই নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। পুলিশি তদন্তে দেখা গেছে, এ ঘটনার পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো গুজব।
আগস্ট ২০২৪-এ শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে দেশে ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দখলদারিত্ব, শিক্ষকদের হেনস্তা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান—বিশেষত মাজার—ভাঙচুরসহ নানা ধরনের অরাজকতা দৃশ্যমান হতে থাকে। এর
ফলে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। পাশাপাশি, দেশে মব জাস্টিসের ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পায়। পূর্বে এসব ঘটনা প্রধানত চুরি, ছিনতাই কিংবা গুজবের ভিত্তিতে সংঘটিত হলেও, ৫ আগস্টের পর থেকে রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করেই অধিকাংশ হামলার ঘটনা ঘটছে।
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শামীম আহমেদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। অভিযোগ ছিল, তিনি উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত ছিলেন। কিন্তু এই অভিযোগ আদালতে যাচাই না করেই, একদল মানুষ তাকে পিটিয়ে হত্যা করে।
পরদিন, ১৮ সেপ্টেম্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল নামের এক মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে চোর সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে জানা যায়, সে কোনো চোর ছিল না, বরং মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মানুষ ছিল, যার জীবন সমাজের ‘বিচারপ্রেমী’ জনতার হাতে নিঃশেষ হয়ে যায়।
৩ মার্চ ২০২৫ রাতে, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর দুই নেতাকে লুটপাটের অভিযোগে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ ছালেক (৩৫), যাঁরা কাঞ্চনা ইউনিয়নের বাসিন্দা। পরে পরিকল্পিত হত্যা বলে দাবি— জামায়াতে ইসলামীর।
এর পরদিন ৪ মার্চ, ২০২৫, ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় দুই ইরানি নাগরিকের উপর ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় একটি মানি এক্সচেঞ্জ অফিসে বিদেশি মুদ্রা বিনিময় করতে গেলে কিছু লোকের সঙ্গে তাদের বিরোধ হয়। এই বিরোধের জেরে স্থানীয়রা তাদের ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনি দেয়। পরে পুলিশ ৯৯৯ নম্বরে কল পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে।
প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজের মৃত্যু একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা হিসেবে স¤প্রতি আলোচনায় এসেছে। ২০২৫ সালের ১৯ এপ্রিল, ঢাকার বনানীতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময়, পাশের দোকানে থাকা দুই নারী শিক্ষার্থীকে দেখে পারভেজ হাসেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই নারী শিক্ষার্থীরা তাদের বন্ধুদের ডেকে আনেন, এবং পরবর্তীতে কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে পারভেজকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এই হামলার ফলে পারভেজের মৃত্যু ঘটে।
২০২৫ সালের ২৭ এপ্রিল সকালে, পূর্বশত্রুতার জেরে গাজীপুরের মাওলানা রইস উদ্দিনের বিরুদ্ধে শিশু ধর্ষণের অভিযোগ তুলে একটি মব গঠন করা হয়। তাকে গাছে বেঁধে পেটে, বুকে, পিঠে, তলপেটে, চোখের নিচে ও মাথায় মারাত্মকভাবে নির্যাতন করা হয়। চার ঘণ্টা মারধরের পর তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পরে কারাগারে রাত সাড়ে তিনটায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পুলিশ হেফাজতে তাঁর এই হত্যাকান্ড দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
পরিসংখ্যানগত তথ্য এই সমস্যার তীব্রতা তুলে ধরে। গণমাধ্যমে উঠে আসা, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, ২০২৪ সালে গণপিটুনির ঘটনায় কমপক্ষে ১২৮ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৯৬ জন মারা গেছেন আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (HRSS) এর নির্বাহী পরিচালক, এজাজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে,গত দশকে সর্বোচ্চ সংখ্যক গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালে, যেখানে কমপক্ষে ২০১টি ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। বছরের শুরু থেকে গণনা করা এই ঘটনাগুলির ফলে ১৭৯ জন নিহত এবং ৮৮ জন আহত হয়েছেন।
এইচআরএসএসের তথ্য এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে, বাংলাদেশে ১,০০৯টি জনতা মারধরের ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে ৭৯২ জন মারা গেছেন এবং ৭৬৫ জন আহত হয়েছেন। এছাড়াও এইচআরএসএসের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে যে, ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাস: কমপক্ষে ৩০টি ঘটনায় ১৯ জন নিহত ও ২০ জন আহত হন।
এসব কেবল গণমাধ্যমে উঠে আসা তথ্য-উপাত্ত এর বাইরেও অনেক ঘটনা ছাপা পড়ে আছে, যা এই পরিসংখ্যানগুলির উদ্বেগজনক বৃদ্ধির প্রতিফলন ও সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ঘটায় এবং পদ্ধতিগত সংস্কারের জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে অপরাধী হোক বা নির্দোষ—সবাইকে ন্যায্য বিচার ও আত্মরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করেছে। সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ আইনের চোখে সকলের জন্য সমান সুরক্ষা নিশ্চিত করে। এসব অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এছাড়া, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারায় বলা হয়েছে, কাউকে অপরাধী হিসেবে সন্দেহ হলে তাকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অপরদিকে, বাংলাদেশ দন্ডবিধির ১৮৭, ৩১৯, ৩২৩, ৩৩৫ ও ৩০৪ ধারায় গুরুতর আঘাত বা মৃত্যুর কারণ হলে যাবজ্জীবন কারাদন্ডসহ বিভিন্ন শাস্তির বিধান রয়েছে। বিশেষ করে, গণপিটুনির মতো সংঘবদ্ধ অপরাধে যদি কারও মৃত্যু ঘটে, তাহলে দন্ডবিধির ৩৪ ধারার আওতায় সংশ্লিষ্ট সকল অংশগ্রহণকারীকে সমানভাবে দায়ী করা হয়।
গণপিটুনি শুধু একজন ব্যক্তির জীবন নয়, তার পুরো পরিবারের জীবনকেও ধ্বংস করে দেয়। শিশুর সামনে যখন তার বাবাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, তখন সেই মানসিক আঘাত থেকে সে সারাজীবন মুক্তি পায় না। একমাত্র রুটি রোজগারকারী মানুষটিকে হারিয়ে পরিবারটি আর্থিক অনিশ্চয়তায় পড়ে, আর সামাজিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হয় “অপরাধীর পরিবার” হিসেবে। অথচ বহুক্ষেত্রে প্রমাণ হয়, নিহত ব্যক্তি আদৌ দোষী ছিলেন না। এই সহিংস প্রবণতা সমাজে এক ধরনের স্থায়ী আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়। মানুষ জানে না—কোন মুহূর্তে সে “সন্দেহভাজন” হয়ে উঠবে। কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই যদি বিচার হয়ে যায় জনতার রায়ে, তাহলে আইনের শাসন এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যায়। এতে দীর্ঘমেয়াদে গড়ে ওঠে এক অসহিষ্ণু ও সহিংস সমাজ। গণমাধ্যম, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম, এখানে দ্বৈত ভূমিকা পালন করছে। একদিকে এটি গুজব ছড়ানোর শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে গণপিটুনির ভিডিও বা তথ্য প্রকাশ করে অনেক সময় ন্যায়বিচারের দাবিও তুলছে। তবে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দায়িত্বশীল তথ্য যাচাই, যাতে ভুল বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর সমাজে বিভ্রান্তি এবং সহিংসতা না ছড়াতে পারে।
মব জাস্টিস বা গণপিটুনি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য এক বিপজ্জনক সংকেত, যা শুধুই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়—এটি একটি গভীর কাঠামোগত ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ। বিভিন্ন রাষ্ট্রদার্শনিক এই ধরনের আচরণকে ন্যায়ের বিকল্প নয়, বরং বর্বরতা ও নৈরাজ্যের পূর্বাভাস হিসেবে দেখেছেন। জ্যঁ জাক রুশো-এর মতে, রাষ্ট্র গঠিত হয় জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা বা ‘general will’ অনুসারে। রাষ্ট্র যদি জনগণের সেই ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটায়, তাহলে জনগণ বিশ্বাস হারায় এবং বিকল্প বিচারব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে। গণপিটুনির ঘটনা সেই বিশ্বাসহীনতার প্রতিচ্ছবি যেখানে রাষ্ট্রীয় আইনের চেয়ে জনগণের তাৎক্ষণিক রাগ ও আবেগ বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু রুশো মনে করতেন, এই ধরনের প্রতিক্রিয়া সামাজিক চুক্তির সম্পূর্ণ বিপরীত এবং রাষ্ট্র গঠনের নৈতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে। সুতরাং মব জাস্টিস কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি একটি সমাজে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অবিচার, বৈষম্য ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার ফল। বিচার যখন আদালতে হয় না, তখন তা ঘটে রাস্তায় এবং সেই বিচার হয় ন্যায় নয়, প্রতিশোধপ্রসূত, উত্তেজনামূলক এবং প্রায়শই বিভ্রান্তিকর। ফলে রাষ্ট্রের উচিত আইন ও বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা, নচেৎ হবসীয় নৈরাজ্য আমাদের ভবিষ্যত হয়ে দাঁড়াবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সম্প্রতি মব জাস্টিস বা গণপিটুনি প্রতিরোধে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, “আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা এ ধরনের কর্মকান্ডে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তিনি জনগণকে আহবান জানান, কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে, যাতে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
গণপিটুনির সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। অপরাধীদের শনাক্তে সিসিটিভি ফুটেজ, ভিডিও ক্লিপ এবং সামাজিক মাধ্যমের তথ্য কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে আইনের শাসন মানেই ন্যায়বিচার; কোনোভাবেই গণপিটুনি গ্রহণযোগ্য নয়। ভুয়া খবর ছড়ানোর প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও তথ্য যাচাই (fact-checking) টুলের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোর উচিত সন্দেহজনক কনটেন্ট দ্রুত শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকে হতে হবে আরও দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল। প্রতিটি গণপিটুনির ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত ও যথাযথ বিচার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভুক্তভোগীর পরিবার ন্যায়বিচার পায় এবং ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে না পারে। অপরাধী যেন কোনো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধ আড়াল করতে না পারে এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান হতে হবে স্পষ্ট ও দৃঢ়। প্রশাসনের সদিচ্ছা ও গতিশীলতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নাগরিকদের ধর্মীয় অনুশাসন ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা কমিয়ে সামাজিক স্থিতিশীলতা বাড়াতে হবে। আইনের শাসনের বাস্তবায়ন, নাগরিক সচেতনতা এবং প্রশাসনিক জবাবদিহিতার সমন্বিত প্রয়াসেই সম্ভব এই ভয়াবহতা প্রতিরোধ করা। তবেই একটি সাম্যভিত্তিক, মানবিক ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

লেখক : প্রাবন্ধিক