মবভায়োলেন্স কি এক অপ্রতিরোধ্য বাস্তবতা?

1

মুহাম্মদ জাবেদ হোছাইন

বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় মবভায়োলেন্স বা গণপিটুনি এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়; বরং এটি বর্তমানে একটি ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি রূপে বিস্তার লাভ করেছে। আইনের শাসনের দুর্বলতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আইন প্রয়োগে শৈথিল্য এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে এ জাতীয় সহিংসতা যেন এক অবধারিত নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি আস্থার ঘাটতি এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা- এই দুইয়ের সমন্বয়ে জনতা অনেক সময় নিজেরাই ‘বিচারক’ হয়ে উঠছে। কিন্তু এই বিচার ন্যায়বিচার নয়; বরং প্রতিশোধ, আবেগ ও গুজবনির্ভর এক ভয়াবহ পরিণতির নাম মবভায়োলেন্স। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে গেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে মব জাস্টিসের কারণে ৩২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালেই গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হন ১২৪ জন। আর ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসেই এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৭ জনে। সংখ্যাগুলো কেবল পরিসংখ্যান নয়; এর প্রতিটি পেছনে রয়েছে এক একটি করুণ মানবিক ট্র্যাজেডি, যন্ত্রণাক্লিষ্ট পরিবার এবং আইনের প্রতি চরম অবিশ্বাস।
মব জাস্টিস বা গণপিটুনির ঘটনা মূলত দুই ধরনের হয়- প্রথমত, অপরাধ সংঘটনের সন্দেহে একজন ব্যক্তিকে ধরে জনতা পিটুনি দেয়; দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক, সামাজিক বা মতাদর্শগত বিরোধের কারণে কাউকে টার্গেট করে জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে গণপিটুনির মতো ঘটনার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় নিরীহ মানুষও গুজব বা ভুল বোঝাবুঝির কারণে এর শিকার হন।
উদাহরণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের শিক্ষার্থী কর্তৃক তোফাজ্জল হোসেন নামের মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবককে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা কিংবা গাজীপুরে ইমাম ও খতিব রইসউদ্দিনকে মতাদর্শগত বিরোধের কারণে বলাৎকারের মিথ্যা অভিযোগ তুলে নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, কেবল সন্দেহ কিংবা মতভিন্নতাই একজন ব্যক্তির জীবন শেষ করে দিতে যথেষ্ট হয়ে উঠছে। বিশেষ করে রইসউদ্দিনের ঘটনা ভয়াবহভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ধর্মীয় বিদ্বেষ কিংবা গোঁড়ামিও কতটা বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা, যাত্রাবাড়ীতে সাঈদ ও ইয়াসিন নামের দুই তরুণকে ধর্ষণের অভিযোগে হত্যা, খিলক্ষেতে জান মিয়াকে গণপিটুনি, কিংবা নোয়াখালীর মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে খুঁচিয়ে পিটিয়ে হত্যা- সবই একই ধারার অংশ। এই ধারার ভয়াবহতা এখানেই যে, একবার যদি জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে, তাহলে সত্য-মিথ্যার যাচাই হয় না, বিচার ব্যবস্থার কোনো সুযোগ দেওয়া হয় না। এই ‘আবেগের বিচার’ হয়ে ওঠে প্রতিহিংসার নরক।
আইনগত দিক থেকে দেখলে, সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনগত নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার রাখেন। কিন্তু মব জাস্টিসের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষেত্রগুলোতে এই অধিকার সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার সুনিশ্চিত করা হলেও গণপিটুনির ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে এবং তার কোনো সুষ্ঠু বিচার হচ্ছে না। এই ধরনের সহিংসতা ফৌজদারি অপরাধ হলেও দুঃখজনকভাবে এসব ঘটনার বেশির ভাগই অচিহ্নিত থেকে যায়, অথবা মামলার দীর্ঘসূত্রতায় কার্যত অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে।
এছাড়া গণপিটুনির শিকার ব্যক্তিদের অনেকেই সাধারণ মানুষ, যাদের অপরাধ প্রমাণিত হয়নি; বরং কোনো ভিত্তিহীন অভিযোগ বা গুজবের ভিত্তিতে তাদের হত্যা করা হয়। এক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তি কখনো কখনো আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপে পরিণত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, ভুল তথ্য ছড়ানো এবং তাৎক্ষণিক আবেগ প্রবণ প্রতিক্রিয়া মবভায়োলেন্সকে উস্কে দেয়।
সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই প্রবণতা ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাচ্ছে। যখন সমাজের একটি বৃহৎ অংশ মনে করে- ‘চোর ধরা পড়েছে মানেই মারধর করতে হবে’, তখন বুঝতে হবে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতাবোধ গভীর সংকটে পড়েছে। আমাদের শিশু-কিশোরেরা এই দৃশ্য দেখে শিখছে যে, আইন নয়, পেশি ও উত্তেজনাই শেষ কথা। এমন একটি প্রজন্ম গড়ে উঠছে যারা সংবিধান বা আদালতের চেয়ে ফেসবুকের লাইভ ভিডিও ও জনতার হাতকেই বেশি কার্যকর মনে করে।
অন্যদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, শ্রেণিগত বিভাজন- এসবই মব জাস্টিসকে আরও জটিল করেছে। বিশেষ করে ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বী ইমামদের বিরুদ্ধে কুৎসারটিয়ে হত্যা করা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে উস্কানি দিয়ে লাঞ্ছনা কিংবা হত্যা করা এসবই একটি অনৈতিক ও ভয়ঙ্কর সংস্কৃতি সৃষ্টি করছে। এতে করে ধর্ম, রাজনীতি ও সামাজিক বন্ধন- সবই দুর্বল হয়ে পড়ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরবতা, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব সবচেয়ে বড় কারণ। অধিকাংশ ঘটনায় দেখা যায়, শুরুতে থানা মামলা নেয় না; পরে গণমাধ্যম ও সামাজিক চাপের মুখে মামলা নিতে বাধ্য হয়। অভিযুক্তদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে টালবাহানা, তদন্তে গাফিলতি এবং বিচারে দীর্ঘসূত্রতা মবভায়োলেন্সের শেক- আরও গভীরে প্রোথিত করছে।
এই ভয়াবহতা প্রতিরোধে কিছু সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। যেমন- ১. আইন প্রয়োগে কঠোরতা : গণপিটুনি সংক্রান্ত প্রতিটি ঘটনায় দ্রুত তদন্ত, অপরাধীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে; ২. আইন সংস্কার ও কঠোরতা বৃদ্ধি : মবভায়োলেন্সকে নির্দিষ্ট অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে ফৌজদারিদন্ড বিধিতে সংশোধন আনতে হবে; ৩. সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি : মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে মবভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালাতে হবে; ৪. ডিজিটাল মিডিয়ার অপব্যবহার রোধ : গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের পাশাপাশি গুজব প্রতিরোধে মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে হবে; ৫. সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত পুনর্গঠন : নৈতিকতা, সহনশীলতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তুলতে পাঠ্যপুস্তক এবং প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
বলাই বাহুল্য, মবভায়োলেন্স একটি ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি যা আইন, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ- তিনটিকেই একই সঙ্গে বিপন্ন করে তোলে। এটি কেবল একজন ব্যক্তির জীবন কেড়ে নেয় না; বরং সমাজে আইন-শৃঙ্খলার প্রতি অনাস্থা, আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এই প্রেক্ষাপটে আমাদেরকে শুধু আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ভরসা করলেই চলবে না; বরং আমাদের সামাজিক দায়িত্ববোধ, সচেতনতা এবং সাহসিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে। জনগণ যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে তাকে আগে অন্যায় থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। আজকের সমাজে মবভায়োলেন্সের যে অপ্রতিরোধ্যতা দেখা যাচ্ছে, সেটি মানবিক ও রাষ্ট্রীয়Ñ উভয় দিক থেকেই চরম হুমকি। এটি এখনই রুখে দাঁড়ানো না গেলে সামনে আরও নির্মম বাস্তবতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
লেখক : আইনজীবী, কবি ও কলামিস্ট