মন্ত্রণালয় কমিয়ে প্রাদেশিক সরকারের প্রস্তাব

2

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) একীভূত ‘ক্যাডার’ পদ্ধতি বাতিলের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন; এর পরিবর্তে কাজের ধরণ ও বিশেষায়িত দক্ষতার ভিত্তিতে ১৩টি প্রধান সার্ভিসে ভাগ করার সুপারিশ এসেছে। ওই ১৩ সার্ভিসে নিয়োগের পরীক্ষা পৃথক তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অধীনে নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
১৩ সার্ভিস হবে- প্রশাসনিক, বিচারিক, জননিরাপত্তা, পররাষ্ট্র, হিসাব নিরীক্ষা, রাজস্ব, প্রকৌশল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, তথ্য এবং তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিস।
গতকাল বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে প্রতিবেদন তুলে দেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। খবর বিডিনিউজের
পাবলিক সার্ভিস কমিশন পুনর্গঠনের সুপারিশ করে কমিশন বলেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দুটো পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করা হয়েছিল। একটি ক্যাডার সার্ভিসের জন্য এবং অপরটি নন-ক্যাডার সার্ভিসের জন্য। পরে দুটোকে একীভূত করা হয়।
প্রজাতন্ত্রের জনবল নিয়োগে তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করার সুপারিশ করে কমিশন বলেছে, প্রতিটি কমিশনের সদস্য সংখ্যা হবে চেয়ারম্যানসহ ৮ জন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বাদে অন্য সব সার্ভিসে নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষা নেবে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (সাধারণ)।
পাবলিক সার্ভিস কমিশন (শিক্ষা) শুধু শিক্ষা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) শুধু স্বাস্থ্য সার্ভিসে নিয়োগ ও পদোন্নতির পরীক্ষা নেবে।

প্রশাসনে যাবে খাদ্য ও সমবায় : ক্যাডার সার্ভিস পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে বিসিএস (খাদ্য) এবং বিসিএস (সমবায়) সার্ভিসকে বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিসের সাথে একীভূত করার সুপারিশ করে সংস্কার কমিশন বলছে, ভবিষ্যতে এ দুটো সার্ভিসে নতুন নিয়োগ করা যাবে না।
বিসিএস (হিসাব ও নিরীক্ষা) সার্ভিসকে দু’টো সার্ভিসে বিভক্ত করার সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি হবে ‘বাংলাদেশ হিসাব সার্ভিস’ ও আরেকটি হবে ‘বাংলাদেশ নিরীক্ষা সার্ভিস’।
এলজিইডি ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর পুনর্গঠনের সুপারিশ করে কমিশন বলছে, দুটি সংস্থায় কর্মরত প্রকৌশলীদের প্রকৌশল সার্ভিস হিসেবে একীভূত করার জন্য সুপারিশ করা হলো। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগদানের তারিখ থেকে পারষ্পরিক সিনিয়রিটি নির্ধারণ করা হবে।
বিসিএস সাধারণ তথ্য ক্যাডারের মধ্যকার তিনটি সাব-ক্যাডার একীভূত করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।
সুপারিশে বলা হয়, এই ৩টি সাব-ক্যাডারে পদোন্নতির সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য রয়েছে। এরূপ বৈষম্য দূর করার জন্য তিনটি সাব-ক্যাডারকে বিলুপ্ত করে তিনটি গ্রুপের (ক) সহকারী পরিচালক/তথ্য অফিসার/গবেষণা কর্মকর্তা, (খ) সহকারী অনুষ্ঠান পরিচালক, এবং (গ) সহকারী বার্তা নিয়ন্ত্রক পদসমূহ নিয়ে একটি একীভূত সার্ভিস গঠন করার সুপারিশ করা হলো।
সম্মিলিত মেধা তালিকার ভিত্তিতে তাদের জ্যেষ্ঠতা, পদোন্নতি ও পদায়ন করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
বিসিএস (তথ্য প্রকৌশল) সার্ভিসকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
নতুন করে ‘বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ সার্ভিস’ গঠনের যুক্তি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিসিএস (বন) সার্ভিসের কর্মকর্তারা বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করেন।
সরকারি চাকরিতে ১৫ বছরের মাথায় সব সুযোগ-সুবিধাসহ স্বেচ্ছায় অবসরের বিধান করার পাশাপাশি ২৫ বছর পূর্ণ হলে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর বিধান বাতিলের সুপারিশও করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাবলিক সার্ভিস অ্যাক্ট, ২০১৮ এর ধারা ৪৫ বিধান অনুসারে ২৫ বছর চাকরির পরে সরকার ইচ্ছে করলে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারে বলে যে বিধান রয়েছে, তা বাতিল করার জন্য সুপারিশ করা হলো।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো অফিসার বা কর্মচারীকে ওএসডি না করার সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো ওএসডি কর্মকর্তাকে কাজ না দিয়ে বেতন-ভাতা দেওয়ার পরিবর্তে তাদের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে শিক্ষকতা বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাময়িকভাবে পদায়ন করা যেতে পারে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে গত ৩ অক্টোবর ১১ সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। ৯০ দিনের মধ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমার কথা ছিল। পরে কমিশনের মেয়াদ ১৫ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
তবে তার আগে গতকাল কমিশন প্রতিবেদন জমা দিল। এছাড়া বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনও এদিন প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছে।
মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিশন মন্ত্রণালয়ের আমূল পরিবর্তনেরও কিছু সুপারিশ করেছে। এখন মোট ৪৩টি মন্ত্রণালয় ও ৬১টি বিভাগ আছে। আমরা মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা হ্রাস করে ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগের সীমাবদ্ধ করতে বলেছি। পাঁচটি গুচ্ছে মন্ত্রণালয়গুলোকে ভাগ করার জন্য আমরা বলেছি।
প্রদেশিক সরকার ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দিয়ে কমিশন প্রধান বলেন, আমরা সরকারের কাছে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করার একটা প্রস্তাব করেছি। আমাদের লোকসংখ্যার কারণে সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন খুব একটা কার্যকর থাকে না।
যদি চারটা প্রদেশ করা যায়, তাহলে একদিকে এই সমস্যাগুলো যেমন দূর হবে, তেমনি রাজনৈতিক দিক থেকেও একটা প্রভাব আসবে। কারণ, একটা কেন্দ্রীয় সরকার একবার বসে গেলে সে পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। প্রদেশ হলে আমরা মনে করি সেটা সম্ভব হবে না। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল বিভিন্ন দেশে এই ব্যবস্থা আছে।
ঢাকার সাভার, গাজীপুরের টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জ নিয়ে একটা ক্যাপিটাল সিটি গভমেন্ট বা অথরিটি করার সুপারিশ করার কথা তুলে ধরে মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, জেলা পরিষদ বাতিল করার জন্য বলেছি। বিভিন্ন ক্যাডারকে কোনো জায়গায় একত্রিত বা একীভূত করার সুপারিশ করেছি। সুপিরিয়র্স এক্সিকিউটিভ সার্ভিস গঠন করার সুপারিশ করেছি। যাতে শীর্ষ পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ সবার হয়। বাইর থেকেও অর্থাৎ বিদেশে অবস্থান করছে- এমন কোনো প্রতিভাবান যেন আসতে পারে।