গত ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ ছিল প্রিয় দৈনিক পূর্বদেশের অর্ধযুগ পূর্তি দিবস। অনিবার্য কারণবশত প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে না পারলেও সবসময় পত্রিকাটির সাথে আছি ভালোবাসার অটুট বন্ধনে। চট্টগ্রামের হাতেগোনা যে কয়টি পত্রিকা আছে তন্মধ্যে পূর্বদেশ খুব অল্প সময়ে পাঠকদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। পাঠকনন্দিত এই পত্রিকাটির জন্য নিরন্তর শুভ কামনা।
এবার আসি আমার নিয়মিত লেখায়। ২০০০ ও ২০০২ এর শৈত্যপ্রবাহ আমিরাতবাসী ভুলতে পারবে না। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে আমিরাতে ছিলাম। অনেক শীত মওসুমও দেখেছি, কিন্তু শীতের কাপড় বলতে যা বোঝায় তা কখনো পরিনি। ঐ সময় ঘন ঘন মেঘলা আকাশ, আগের বছর বৃষ্টি ধূলিঝড় সব মিলে ঠান্ডার বন্যা বয়ে গিয়েছিল সাহারার এই তপ্ত ভূমিতে। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। সকালে চোখ খুলেই খেজুরের রস দিয়ে ভাপাপিঠা খেতে মন চাইল। অনেকদিন খেজুরের রস দিয়ে ভাপাপিঠা খাইনি। এখানে প্রচুর খেজুর বৃক্ষ। আরবীরা আমাদের রস বের করে ফেললেও কখনো খেজুরের রস বের করতে দেখিনি। মনের নাম মহাশয়। তো এই মহাশয়ের ভাপাপিঠা খাওয়ার ইচ্ছা জেগেছে। কিন্তু ভাপাপিঠা বানাবে কে ? এখানে দক্ষিণ ভারতীয় হোটেলগুলিতে ভাপাপিঠার মত পিঠা পাওয়া যায়। এগুলোকে ইডলি বলা হয়। আমরা ভাপাপিঠায় গুড় ও নারিকেল মিলায়ে থাকি। কিন্তু ইডলিতে গুড় নারিকেল থাকেনা। দক্ষিণ ভারতীয়রা বেগুন দিয়ে একটি ঝোল ওয়ালা তরকারি রান্না করে। ওদের ভাষায় সাম্বার। এই সাম্বার দিয়ে ভাতের মত কচলিয়ে কচলিয়ে ইডলি খায় তারা। দক্ষিণ ভারতীয় একটা হোটেলে চলে গেলাম। গরম গরম দুটি ইডলি সোলেমানি চা (রঙ চা) দিয়ে চুবিয়ে চুবিয়ে খেলাম। অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো আরকি। দক্ষিণ ভারতীয় হোটেলগুলিতে তাদের জাতীয় খাবারের মধ্যে মোটাসেট, বারিক সেট, দোসা, ইডলি, ওখমা, ওয়াডা, গুলগুলা ও প্যাকোড়া ইত্যাদি পাওয়া যায়। আমি মাঝেমাঝে দোসা খাই। দোসা আমাদের দেশের পাটিসাপ্টা পিঠার মত। পাটিসাপ্টা আকারে একটু ছোট হয় এবং নারকেল কুচি দেয়া হয়। আর দোসা একটু বড় আকারের হয়, এটাতে নারকেল কুচি দেয়া হয়না। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় এই ধরনের পিঠাকে তেলইন্যা পিঠা বলা হয়। যাক, এই কনকনে শীতে খেজুরের রস আর ভাপাপিঠা না পেয়ে ইডলি আর গরম গরম রং চা’তে অতৃপ্ত রসনাকে তৃপ্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা। এভাবেই প্রবাসীদেরকে সবকিছুর ব্যাপারে নিজের ইচ্ছা আকাক্সক্ষা ও চাহিদা প‚রণের বিকল্প চিন্তা-ভাবনা করতে হয়। যাকে আমি সহজ ভাষায় আত্মপ্রবঞ্চনা বলে থাকি। এরফলে কেউ পায় কষ্ট, কেউ হয় নষ্ট। আর ঝকঝকে তকতকে দুবাই শহরে পাওয়া যায়না এমন জিনিস নেই। যা পাওয়া যায়না তাহলো মায়ের হাতের রান্না, বোনের মমতা ও স্ত্রীর ভালোবাসা।
পরিচ্ছন্ন এই শহরে দুবাই মিউনিসিপ্যালিটির অধীনে পেস্ট কন্ট্রোল নামের একটি পৃথক বিভাগ রয়েছে। তাদের কাজ মশা, মাছি, ইঁদুর, বিড়াল, কুকুর, ছারপোকা, তেলাপোকা ইত্যাদি অবাঞ্চিত প্রাণী নিধন করে শহরটাকে পরিচ্ছন্ন রাখা। আমাদের সিটি কর্পোরেশনগুলি অধিকাংশ সময় মশা নিধনের চেয়ে মশক উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। লোডশেডিং এর সময় একঝাক মশা চারিপাশে গুনগুন করে নৃত্য করে। অথচ পৌরকর মাফ নেই। প্রবাসীরা দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে শামিল। পোশাক শ্রমিক আর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করেছে। অথচ এই দুটি খাত আজ অবহেলিত। দুবাইর শ্রমবাজার বন্ধ আজ প্রায় অর্ধযুগের চেয়েও বেশি। কত মন্ত্রী বদল হল, কত মন্ত্রণালয় পরিবর্তন হল, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এলেন কিন্তু অবস্থা তথৈবচ। প্রবাসীদের কষ্ট দেশে অবস্থানরত কেউ উপলব্ধি করতে পারবেনা। কারণ- চির সুখিজন ভ্রমে কী কখন ব্যথিত বেদন, কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে’। প্রবাসীরা দেশে যখন স্বল্পকালীন ছুটিতে যায়, তখন তাদের বুকে থাকে অকৃত্রিম দেশপ্রেম। মুখে থাকে দিগবিজয়ের হাসি। চোখে থাকে প্রিয়জনের স্বপ্ন। কিন্তু দেশমাতৃকার নিরাপদ আঁচলে স্বল্পকালীন সেই প্রবাসী অতিথি যদি নিজদেশে স্বদেশীয় ভাইদের হাতে বিমান বন্দরে কাস্টমস চেকিং এর নামে একশ্রেনীর শিক্ষিত অফিসারের হাটে লাঞ্ছিত ও লুণ্ঠিত হয় তবে আফসোসের সীমা থাকেনা। প্রবাসীরা দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণকারী। অথচ প্রবাসীদের ভোটাধিকার নেই। প্রবাসীদের গৃহ নির্মাণে সরকারের সহযোগিতা তো নেইই অধিকন্তু আয়কর বিভাগ ও নগর উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক নানাবিধ হয়রানির শিকার হতে হয়। কয়জন প্রবাসী সরকারি কোটায় ফ্ল্যাট পেয়েছেন ? আজ আমাদের থেকে শিক্ষা ও অর্থনীতিতে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তান সরকারও সেই দেশের প্রবাসীদের জন্য নানাবিধ সুবিধার দ্বার খুলে দিয়েছে। সরকারের নিকট প্রবাসীদের প্রত্যাশা প্রবাসীদের যথাযথ সম্মান ও অধিকার দিয়ে উৎসাহিত করা হোক।
শীতের সকাল। কুয়াশার ধুম্রজালে অস্পষ্ট নগরী। মদিনা জায়েদের ছোট্ট শহরটি সবেমাত্র জেগে উঠেছে। রাস্তার নিয়নবাতিগুলো মরা ইলিশের চোখের মত আলোহীন সাদাটে হয়ে আছে। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলির শ্রমিক বহনকারী বাসগুলি সারিবদ্ধভাবে ছুটে চলেছে তাদের স্ব স্ব কর্মস্থলে। এদেশ গণতন্ত্রের দেশ নয়, কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশগুলির মত এখানে মানুষ কখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেনা। এইদেশে নির্বাচন নেই, তাই কেয়ারটেকার সরকারের দাবিও নেই। ভোট কারচুপি কিংবা ভোট ডাকাতির প্রশ্নও আসেনা। হরতাল, অবরোধ, ভাঙচুর জ্বালাও-পোড়াও নেই। আছে উন্নয়ন আর উন্নয়ন। স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পর সংযুক্ত আরব আমিরাত আজ কোথায় ? আর আমরা কোথায় ? ১৯৭১’র ২ ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাত বৃটিশের নাগপাশ থেকে রক্তপাতহীন এক স্বাধীনতা লাভ করে। একই সালের ১৬ ডিসেম্বর মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমরা দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের লোকদের কর্তব্য ছিল দেশ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য ঐ সময় নতুন রাজনৈতিক দল জাসদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তারা নানাভাবে সদ্য স্বাধীন দেশের সরকারকে সহযোগিতার পরিবর্তে দারুণভাবে অসহযোগিতা করেছিল। পাটের গুদামে আগুনের পর আগুন লাগিয়ে বাংলাদেশের মূল্যবান সম্পদ সোনালী আঁশ নামে খ্যাত সেই মূল্যবান সম্পদ ধ্বংস করেছিল। আজ অবধি চলছে সেই ধ্বংসযজ্ঞের পৈশাচিক ধারাবাহিকতা। আমরা বাঙালিরা স্বাধীনতার যথার্থ মূল্যায়ন অনুধাবন করতে পারিনি। আজও ব্যক্তি বিদ্বেষ আর দোষারোপের রাজনীতিতে আমাদের নেতারা সময় নষ্ট করছেন।
দেশ গোল্লায় যাক, ক্ষমতা তাদের চায়ই। এদের চিহ্নিত করা জরুরি। এরা মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে নানাভাবে দেশবিরোধী কর্মসূচির পরিকল্পনা করে থাকে। দেশ এদের কাছে কখনো বড় ছিল না। না দেশ, না ধর্ম এদের কাছে কোনটিই বড় না। এরা নিজেদের বিলাসী জীবন-যাপনের জন্য ক্ষমতাকে নিজের করে পেতে চায়। সাং বৎসর উদম মাথায় থাকলেও ভোটের প্রাক্কালে সকলের মস্তকে টুপি দেখা যাচ্ছে। টুপিগুলো দেখেই মনে হয় নিজের টুপি না। কারো মাথা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের পাকা তাল ঢেকেছে। মোদ্দাকথায় টুপিটা মাথার সাথে খাপ খেতে পারেনি। কেন বাপু, সারা বছর তো টুপিওয়ালাকে গালি দাও। আজ নিজে টুপিওয়ালা হওয়ার সাধ জাগলো কেন ? এতেই বোঝা যায় টুপির বদনামি কারা করে।
নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হতে না হতেই মারামারি, খুনোখুনি আরম্ভ হয়েছে। বাকি পথ এখনো বাকি। ভোট আসলেই সবাই সাধু হয়ে যায়। রমজান আসলেই সব ব্যবসায়ীরা যেমন মক্কা-মদিনা মার্কা টুপি লাগায়, আল্লাহ্র নামে শপথ করে অধিক মুনাফায় রোজাদার মুসলমানদের গলা কাটে, ঠিক তেমনিভাবে ভোটের সময় টুপি মাথায় আল্লাহ্র সাচ্চা বান্দা সেজে সমাজের অসাধু মানুষগুলো জনগণের দোরগোড়ায় ভোট চাইতে আসেন।
অযোগ্য লোকেরাই টাকার জোরে নমিনেশন কিনে নিয়ে জনপ্রতিনিধির আসনে বসার সকল আয়োজন করতে থাকে। আফসোস, আফসোস শুধুই আফসোস !
লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক