মনিরুল ইসলাম মুন্না
বিদেশি ফল এখন বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে মধ্যবিত্তদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। তবে আমদানিকারক ও বিক্রেতাদের দাবি, মৌসুম শেষ, ডলারের দামবৃদ্ধি এবং বন্দরের ডিউটি ফি- এ তিন কারণে ফলের দাম এখন দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল রবিবার ফল সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
তবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন পূর্বদেশকে বলেন, আমদানিকারক বলেন বা ব্যবসায়ী বলেন, সবাই পুরাতন অজুহাতগুলো সামনে আনছেন। এখন তো ডলারের রেট কমেছে, কই তার প্রভাব তো পড়েনি। ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলে দাম বাড়িয়ে দেন। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে ফলের দাম কমে, তখন দাম কমান না। যেমন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম কমিয়েছে। তবে সেগুলো কাগজে-কলমে থেকে গেলেও বাস্তবে তার প্রভাব নেই।
তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের যথাযথ বাজার মনিটরিং হচ্ছে না। পরিবেশ উপদেষ্টার প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে কথা বলার পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছে। কিন্তু জনগণের কি সমস্যা, তা নিয়ে জেলা প্রশাসন কাজ করেনি। অথচ জনগণের পক্ষ নিয়ে প্রশাসনের অভিযান পরিচালনা করা উচিত, উপদেষ্টাকে খুশি করার জন্য নয়।
এদিকে ফল ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক মাসের ব্যবধানে বিদেশ থেকে আমদানি হওয়া প্রত্যেকটি ফলের দাম কেজিতে পঞ্চাশ থেকে দেড় শ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এতে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে আপেল, কমলা, আঙুর ও আনারের মতো বিদেশি ফল। এসব ফল এখন ধনীদের খাবার হিসেবে গণ্য হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের মতে, বিশ্বে বছরের আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর- এ তিন মাস ফলের মৌসুম থাকে না। এ সময় কোথাও ফল পাওয়া যায় না। কিছু কিছু আমদানি হওয়া ফল দেশের কোল্ড স্টোরেজে রাখা হয়। তাই এই তিন মাসে দেশে আমদানি কমায় বাজারের ফলের দাম বেড়ে যায়।চট্টগ্রামের ফলমন্ডি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ফল আমদানিকারক তৌহিদুল আলম বলেন, ফলের মৌসুম নেই, ডলারের দামবৃদ্ধি এবং বন্দরের ডিউটি ফি বেশি হওয়ার কারণে বিদেশি ফলের দাম এখন বাড়তি। আগে ১০০ টাকা দিয়ে মাল্টা পাওয়া যেতো, কিন্তু গত এক বছর আগে এসব বিদেশি ফল অভিজাত পণ্য ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভূক্ত করায় কেজিতে ১০০ টাকা করে বেড়েছে। তাই ডিউটি কমালে দাম অনেকটা কমে আসতো। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারসহ সারা পৃথিবীতে এখন ফলের মৌসুম নেই। আফ্রিকার কিছু গুদামে ফল রয়েছে, সেগুলো চড়া দামে আমদানি করতে হচ্ছে। আবার বর্তমানে একটা আপেলের মৌসুম রয়েছে, সেটা কিছুটা কম। আবার দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক থেকে লেনদেন বা ঋণপত্র খোলা (এলসি) করা যাচ্ছে না। এর প্রভাব আমদানি রপ্তানিতে পড়েছে।
জানা গেছে, দেশের বাজারে বিদেশি ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিদেশি ফলের মধ্যে আপেল, কমলা, আঙ্গুর, মাল্টা, খেজুর, নাশপাতি, আলুবোখারা আমদানি হয়। এসব ফল বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, মিসর, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে আসে।
উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দরের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ শাহ আলম পূর্বদেশকে জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে মৌসুম না থাকাতে ফল আমদানি বন্ধ রয়েছে। তবে দক্ষিণ আফ্রিক এবং চীন থেকে আমদানি স্বাভাবিক আছে। দেশে চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান ও মিসর থেকে বিভিন্ন ফল আমদানি হয়। খেজুর আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। তবে আগে যে পরিমাণ ফল আসতো, এখন মৌসুম না হওয়ায় পরিমাণ একটু কমেছে।
সরেজমিন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে চীনের আপেল ৮০ টাকা বেড়ে ৩০০ টাকা, দক্ষিণ আফ্রিকার আপেল ৫০ টাকা বেড়ে ৩৫০ টাকা, অস্ট্রেলিয়ার আপেল ৮০ টাকা বেড়ে ৪০০ টাকা, দক্ষিণ আফ্রিকার কমলা ১০০ টাকা বেড়ে ৩৬০ টাকা, ভারত ও মিসরের ডালিম ১৫০ টাকা বেড়ে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার মাল্টা ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চীন ও ভারতীয় কালো আঙুর ৫০ টাকা বেড়ে ৫০০ টাকা, মধ্যপ্রাচ্যের খেজুর ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা, মানভেদে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া নাশপাতি ৫০ টাকা বেড়ে ৩০০ টাকা, আলুবোখারা (শুকনা) ৫০ টাকা বেড়ে ৫৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
ষোলশহর কর্ণফুলী মার্কেটের ব্যবসায়ী ও খুচরা ফল বিক্রেতা আবদুল মান্নান বলেন, পাইকারিতে প্রত্যেক ফলের কার্টনে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। ফলে আমরাও খুচরায় বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।
ফলমÐির জননী এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. নাজিম বলেন, চীনের লাল আপেল ২০ কেজির কার্টন ৪ হাজার ২০০ টাকায়, ১৫ কেজির মাল্টা ৩ হাজার ৬০০ টাকা, ১০ কেজি কার্টনের কমলা ২ হাজার ৫০০ টাকায়, লাল আঙ্গুর ৭ কেজির কার্টন ২ হাজার ৫০০ টাকায় পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ান আপেল ২০ কেজির কার্টন ৫ হাজার টাকা, আফ্রিকান আপেল ৫ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে আনার মানভেদে ১৭ কেজির কার্টন ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আল হাসান নামে এক ফল ক্রেতা জানান, আমরা রোগী দেখতে গেলে আপেল, মাল্টা, আনার, আঙ্গুর সেগুলো নিই। কিন্তু বর্তমানে এসব আর নেয়ার উপায় নেই। যে দাম বেড়েছে, তা নিতে সাহসে ধরে না। এখন বাধ্য হয়ে কোনো রোগী দেখতে গেলে পাউরুটি আর কলা নিয়ে যাই। বিদেশি ফলের দাম কমাতে প্রশাসনের আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত।