মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির মূল কারণ আমেরিকা ও ইসরাইলের আগ্রাসী নীতি

1

জসিম উদ্দিন মনছুরি

১৯৪৮ সালে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল গঠিত হওয়ার পর থেকে মূলত মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি বিরাজমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রিফিউজি ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে ইহুদিরাষ্ট্র গঠন করে। ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যূত করে ফিলিস্তিনের অধিকাংশ জায়গা ইহুদিবাদীরা জবরদখল করে নেয়। মুসলমানদের প্রথম কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাস এর নিয়ন্ত্রণও হারায় মুসলমানরা। ইহুদিরাষ্ট্র গঠনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ইহুদিরা নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। আমেরিকা পুরো পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য ইহুদিবাদীদের পক্ষ নিয়ে থাকে। ইসরাইলকে ব্যাপক অস্ত্র ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে তাদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণ করার দুর্বিসন্ধি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের। দাদাগিরি করা আমেরিকার স্বাভাবিক একটি নীতি। আমেরিকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘস্থায়ী করতে ইরানকে অস্ত্র ও মদদ দিয়ে আসছিলো। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব ঘটলে যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট রাষ্ট্রপ্রধান রাজা পেহলবী ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পলায়ন করেন। সাথে সাথে আমেরিকারও পরাজয় ঘন্টা বেজে ওঠে। এরপর থেকে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর প্রায় এক চতুর্তাংশ সম্পদ মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে। বিশেষ করে অপরিশোধিত তেল মধ্যপ্রাচ্যের অমূল্য সম্পদ। যুক্তরাষ্ট্র সম্পদের লোভে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশকে টার্গেট করে আক্রমণ করে।
রসায়নিক অস্ত্র আছে মর্মে আমেরিকা সাদ্দাম হোসেনের ইরাকে হামলা চালিয়ে প্রাচীন সভ্যতার দেশ ইরাককে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করে। ক্ষমতাচ্যূত হয় আমেরিকা বিরোধী প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের। নিজেদের মনগড়া বিচারে আমেরিকার নির্দেশে সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। আগ্রাসী নীতি সহজ করতে আমেরিকার পরবর্তী টার্গেটে পরিণত হন লিবিয়ার লৌহমানবখ্যাত প্রেসিডেন্ট মোয়াম্মার আল গাদ্দাফি। লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে আমেরিকা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ব্যাপক সম্পদ লুণ্ঠন করে। হত্যা করা হয় দেশ প্রেমিক গাদ্দাফিকে।
আরব রাষ্ট্রের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বন্ধুত্ব দেখিয়ে তাদেরকে পুতুল সরকারে পরিণত করে তাদের সম্পদ হস্তগত করা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাই লক্ষ্য। এ লক্ষ্য নিয়ে আমেরিকা ইসরাইলকে রক্ষা করার জন্য অস্ত্র দিয়ে ও আকাশ প্রতিরক্ষা সিস্টেম আইরনডোম দিয়ে মুসলিম নিধনে সহায়তা করে যাচ্ছে। ওপেন সিক্রেট হলেও ইসরাইলের প্রায় ৯০ টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তাছাড়া অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইসরাইলের অধিকাংশ অস্ত্রই আমেরিকার বলে কথিত আছে। আমেরিকা ইসরাইলকে রক্ষা করার জন্য অন্ধভাবে সমর্থন ও জাতিসংঘে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে আসছে। আমেরিকা কখনো চায় না মধ্যপ্রাচ্যে নব শক্তির উত্থান হোক। ইরান আমেরিকাকে পরোয়া না করে নিজেদের অস্ত্রভান্ডার সমৃদ্ধকরণে এগিয়ে যাচ্ছে। ইরানের অত্যাধুনিক ড্রোন, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, শক্তিশালী নৌবাহিনীর কাছে পৃথিবীর যে কোন শক্তিই পরাস্ত হতে বাধ্য। ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নিজেদের অস্তিত্বের হুমকি মনে করে ইসরাইল ও আমেরিকা।
দীর্ঘদিন ধরে ইরান আমেরিকা ও ইসরাইলের চক্ষুরাঙানিকে উপেক্ষা করে ইউরিনিয়াম সমৃদ্ধ করণের জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ধারণা করা হয় বর্তমানে ইরানের প্রায় ছয়টির মত পারমাণবিক বোমা বানানোর সক্ষমতা রয়েছে। যা ইসরাইল ও আমেরিকার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ২০১৫ সালে আমেরিকার সাথে ইরানের সংগঠিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সরিয়ে নেয়। ইরানকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আমেরিকা ইসরাইলকে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে ইসরাইলের অনৈতিক হত্যাযজ্ঞকে বৈধতা দিয়ে আসে বারবার। মুসলিম দেশ সমূহ নিরব থাকলেও এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে ইরান সোচ্চার। স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনের হামাস ইরানের অস্ত্র দিয়ে ইসরাইলকে প্রতিরোধ করে আসছে বলে জানা যায়। ইরানের প্রক্সিযোদ্ধা লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়ামেনের হুতিরা উল্লেখযোগ্য। ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালের পর থেকেই ইসরাইল নির্মমভাবে প্রায় ৬১ হাজার ফিলিস্তিনি নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই হত্যাযজ্ঞের পরেও বিশ্ববিবেকখ্যাত আমেরিকার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি সৃষ্টি হয়নি বরং বাস্তুচ‚্যত বিধ্বংস গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে গাজা দখলে নেওয়ার আগ্রাসী নীতি অবলম্বন করে।গাজাকে চতুর্দিকে বেষ্টন করে রাখে যাতে গাজার অভ্যন্তরে কোন ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে না পারে। গাজার নিরীহ মানুষদের ও গাজাকে আমেরিকা ও ইসরাইলের যৌথ আক্রমণে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে ইয়ামানের প্রতিরোধযোদ্ধা হুতিরা ইসরাইলের অভ্যন্তরে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে। তাতে ইসরাইল ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
একদিকে লেবাননের হিজবুল­াহ অন্যদিকে হুতি ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের আক্রমণে অস্তিত্বহারা হওয়ার ভয়ে ইসরাইল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে দখলকৃত অঞ্চলের কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করতে চায়। এরপরও প্রতিরোধযোদ্ধারা নিজেদের শক্তি জানান দিচ্ছে। সা¤প্রতিক সময়ে ইয়ামানের হুতিরা পারস্য উপসাগর ইয়ামেনসাগর, আরবসাগরে দূরপাল্লার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আমেরিকা ও ইসরাইলের যুদ্ধজাহাজে বারংবার হামলা চালিয়ে আসছে। ফলে এই রুট পরিহার করতে বাধ্য হয়েছে আমেরিকা ও ইসরাইলি পণ্যবাহী জাহাজ। তাঁরা আমেরিকার বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক ড্রোনকেও ভূপতিত করেছে। কথিত আছে হুতিরা ইরানি অস্ত্র দিয়ে আমেরিকা ও ইসরাইলকে ঘায়েল করে যাচ্ছে। এরই মাঝে যদি ইরান পারমানবিক শক্তিধর হয়ে যায় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য ইরানের হাতে চলে যাওয়ার ভয়ে আমেরিকার চক্ষু কপালে ওঠে গেছে। ইরান নিজেদের অস্তিত্বের হুমকি ইসরাইলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য হুমকি দিয়ে থাকে। আমেরিকা ২০২০ সালে ইরানের বিপ্লবী গার্ডের প্রধান অজেয় বীর সুলাইমান কাসেমীকে বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে ড্রোন দিয়ে গুপ্তহত্যা করে। প্রতিবাদে ইরানও ১০০ টির মত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরাইলে। অপ্রকাশিত থাকলেও এ হামলায় ইসরাইলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২০২৪ সালে ইরানের চৌকস প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইছি আজারবাইজান প্রদেশের দুর্গম এলাকায় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হলে হত্যার তীর আমেরিকা ও ইসরাইলের দিকে ছুঁড়ে দেয় ইরান। এরপর থেকে ইরান নিজেদের সমরাস্ত্র শক্তিকে অতি উচ্চতায় নিয়ে যায়। ভূ-গর্ভে ক্ষেপণাস্ত্র শহর নির্মাণ করে তাদের রণকৌশলের জানান দিয়েছেন। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইলের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ইরানকে কুপোকাত করতে গিয়ে নিজেরাই নাজেহাল হচ্ছে। ইরান অস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অত্যাধুনিক ড্রোন, মিসাইল এবং পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠার সম্ভাবনায় আমেরিকার মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প ইরানকে হুমকি দিয়ে বসে যদি ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ থেকে পিছিয়ে না আসে তাহলে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হবে। ইরানও কম যায়না তাঁরাও জবাব দিতে গিয়ে আমেরিকাকে পাল্টা হুমকি ছুঁড়ে দেয়। এর মাঝে ওমান ও ইউরোপে ইরানের সাথে আমেরিকার দুইটি বৈঠক হলেও কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠকের সমাপ্তি হয়। ইরান সাফ জানিয়ে দেয় তারা কারো হুমকিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ থেকে পিছু সরবে না। ধারণা করা হচ্ছে ইরান ছয়টি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরীর কাছাকাছি চলে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরম মিত্র ইসরাইল ইরানে হামলা করার জন্য সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে জানা যায়। তবে ইরানসহ ইরানের প্রক্সিযোদ্ধারা যদি চতুর্দিক থেকে হামলা শুরু করে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইল পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কসাইখ্যাত বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরাইলকে রক্ষা করার জন্য ফিলিস্তিনকে নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে দেশের অভ্যন্তরেও প্রতিবাদ ও নিন্দার সম্মুখীন হচ্ছে। ইয়ামেনের হুতিরা যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে ঘায়েল করে চলছে, সাথে যদি ইরানও যুক্ত হয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ হলেও হয়তো ইরানই বিজয়ী হতে পারে। তখন পৃথিবীর মোড়ল আমেরিকার পিছু হঠার সম্ভাবনা খুব বেশি। আমেরিকা যদি পিছু হটে ইসরাইলকে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করে নিশ্চিহ্ন করা সময়ের ব্যাপার। আমেরিকা যেভাবে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে মধ্যপ্রাচ্যে হয়তো আরও একটি যুদ্ধ সন্নিকটে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সৌদি আরব, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজেদের আকাশ সীমা ব্যবহার করে ইরানে আক্রমণ করতে দিবে না বলে যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছে। তাহলে আমেরিকা এত সহজে ইরানকে ঘায়েল করতে পারবে না বরঞ্চ ইসরাইল ও আমেরিকাকে কিছু হটতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল যদি পরাজয়বরণ করে তাহলে হয়তো ফিলিস্তিনিরা তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা ও নিজেদের ভূমি উদ্ধার করতে পারবে বলে বোদ্ধাদের ধারণা। এই মুহূর্তে আমেরিকার উচিত আগ্রাসী নীতি পরিহার করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসা। অন্যতায় অর্থনীতির যেমন ক্ষয়ক্ষতি হবে তেমনি ব্যাপক মানুষের প্রাণহানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীলতার জন্য আরবরাষ্ট্রসমূহ ও ইরানের ঐক্য নিতান্তই প্রয়োজন। মধ্যপ্রাচ্যের আরবরাষ্ট্র ও ইরান যদি ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে আমেরিকা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে। ইসরাইলও নিজেদের আগ্রাসিনীতি ও হত্যাযজ্ঞ পরিহার না করলে তাদেরও করুণ পরিণতি হতে পারে। সময় বলবে ইরানের হুংকার নাকি সত্যি সত্যি তারা সমরাস্ত্রে সজ্জিত পৃথিবীর নবশক্তি। পৃথিবীবাসী চায় স্থায়ী শান্তি। মধ্যপ্রাচ্যে সমরাস্ত্রের প্রতিযোগিতা বন্ধ হোক। জয় হোক ফিলিস্তিনের। জয় হোক ইরানের।
লেখক : প্রাবন্ধিক