অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবশেষে বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করার বিষয়ে নীতিগত যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, তা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। উপদেষ্টাদের পক্ষ হতে বেশ কিছুদিন ধরে এই আইন বাতিল বা সংশোধন করার বিষয়ে যে আগ্রহ আমরা দেখেছিলাম, এই পদক্ষেপে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ গত বছর বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে। মূলত সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সমালোচনার মুখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করলেও, সাইবার নিরাপত্তা আইনে নিপীড়নের কিছু ধারা রাখা হয়। এ কারণে সাংবাদিক সমাজসহ বিভিন্ন পর্যায় হতে তখনই আইনটির বিরুদ্ধে জোরালো আপত্তি উঠেছিল।
সাইবার নিরাপত্তা আইনে পূর্বের আইনের সাথে সাদৃশ্য রেখে এমন কিছু ধারা যুক্ত করা হয়েছিল, যা জামিনযোগ্য নয়। অথচ জামিন পাওয়া যে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সাল হতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিন সহস্রাধিক মানুষের নামোল্লেখ এবং দুই সহস্রাধিক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের তথ্য অনুসারে, পরবর্তী সময়ে সাইবার নিরাপত্তা আইনে আরও ৩৭২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। এসব মামলা করা হয়েছিল মূলত হয়রানি এবং উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কণ্ঠরোধে। কারণ, এর প্রায় অর্ধেক সংখ্যকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল সরকার, পদধারী বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা সমালোচনামূলক পোস্টের কারণে। বলা বাহুল্য, এই আইনে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাংবাদিক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্তদের এক-তৃতীয়াংশ এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনে আসামিদের এক-চতুর্থাংশ ছিলেন সাংবাদিক।
সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারা অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালায় বা তাতে মদদ দেয় তাহলে সেটি অপরাধ বলে গণ্য হতো এবং এর জন্য সাজার মেয়াদ ৭ বছর করা হয়। ৪৩ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন যে, কোনো স্থানে এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাহলে সাক্ষ্য প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছে ফেলা, পরিবর্তন হওয়ার বা করার সম্ভাবনা রয়েছে তাহলে তার, কোন পরোয়ানা ছাড়াই সেখানে তল্লাশি, সরঞ্জাম জব্দ, দেহ তল্লাশি এবং পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতারের এখতিয়ার রয়েছে।
২৯ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে তিনি তিন বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। এছাড়া একই অপরাধ বারবার পাঁচ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। এই ধারায় পরিবর্তন এনে কারাদন্ডের যে সাজা ছিল সেটা বিলুপ্ত করা হয়। এখানে শাস্তি হবে শুধু জরিমানা। আর জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ড হতে পারে। মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা আইন যেভাবে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছিল, তাতে এটি বাতিল জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে মতপ্রকাশ সংক্রান্ত মামলা দ্রæত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৩শ মতপ্রকাশ সংক্রান্ত মামলার মধ্যে বিচারাধীন প্রায় ৯শ মামলা আইন মন্ত্রণালয়ের সাথে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে দ্রুত প্রত্যাহার করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
আমরা মনে করি, মতপ্রকাশের অধিকার চর্চায় অন্তর্বর্তী সরকারের এই পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। একইসঙ্গে অন্য কোনো আইনেও যাতে কারও মতপ্রকাশ বাধাপ্রাপ্ত না হয় তাও নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে অনুরূপ নিপীড়নমূলক কোনো আইন প্রণয়ন করা না হয়, সেই ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট সকলের অঙ্গীকার করা দরকার। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের পাশাপাশি রাজনীতিকদেরও ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেছেন, গণমাধ্যম এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনভাবে কাজ করছে। আমরা এ বক্তব্যের কার্যকারিতা তখনই উপলব্ধি করবো, যখন সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল হবে; নিশ্চিত হবে মতপ্রকাশের অধিকার।