ভোটে দায়িত্ব পালন করবেন কারা

2

বিবিসি বাংলা

বাংলাদেশে গত তিনটি নির্বাচনে ‘মিনিমাম ইনভলবমেন্ট’ অর্থাৎ ‘ন্যূনতম অংশগ্রহণ’ ছিল এমন সব কর্মকর্তাদের আগামী নির্বাচনে কোনো দায়িত্বে রাখা হবে না, অন্তর্বর্তী সরকারের এমন ঘোষণা নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ঢালাওভাবে সব কর্মকর্তাদের নির্বাচনের অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করলে আগামী নির্বাচনে কারা দায়িত্ব পালন করবেন কিংবা এর মাধ্যমে একটি গোষ্ঠীকে সাইডলাইনে ফেলে আরেক গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে আমলাতন্ত্রে নতুন করে বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে কি না সেই প্রশ্নও উঠছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের দিক থেকে কর্মকর্তাদের প্রতি এমন ‘বাছবিচারহীন ঢালাও অনাস্থা’ অনেক কর্মকর্তাকে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক করে তুলেছে এবং এর জের ধরে আমলাতন্ত্রে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারে।
নির্বাচন কমিশন অবশ্য জানিয়েছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য কর্মকর্তা বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছে তারা।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘সবচেয়ে বিতর্কিত কিংবা পক্ষপাতমূলক বলে যারা চিহ্নিত হবেন তারা বাদ পড়বেন এটা নিশ্চিত। তবে সেটি নির্ধারিত হবে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায়। নির্বাচনে অনেকে দায়িত্ব পালন করেন, সবাইকে তো তার বাদ দেওয়া যায় না।’
ওদিকে সরকারের দিক থেকেও নির্বাচন কর্মকর্তাদের যাচাই বাছাইয়ের তৎপরতা শুরু হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সম্ভাব্য কর্মকর্তাদের বিষয়ে নানা তথ্য সংগ্রহ করছে।
যদিও বিতর্কিত হওয়া কিংবা ঝামেলা এড়াতে কর্মকর্তাদের অনেকেই নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে অনিহা প্রকাশ করছেন এমন খবরও আসছে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে। এর আগে চলতি বছরের জুলাইতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন ভোটে অনিয়ম বন্ধে এবার নির্বাচনী কর্মকর্তা নিয়োগে নতুন কৌশল নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।সেক্ষেত্রে প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগে বড় পরিবর্তনের পাশাপাশি কোথাও কোথাও জেলা প্রশাসকদের পরিবর্তে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবেও নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন চলতি বছরের জুলাইয়ে ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’য় সংশোধনী এনে সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র স্থাপনের কর্তৃত্ব থেকে ডিসি -এসপিদের বাদ দিয়েছে।
অবশ্য চলতি বছরের শুরু থেকেই গত তিন নির্বাচনে যারা রিটার্নিং অফিসার ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করে অন্তর্র্বতী সরকার। ২০১৮ সালের নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ৪৫ জনকে চলতি বছরের শুরুতে ওএসডি করেছিলো সরকার।
এছাড়া বিগত তিনটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা সাবেক জেলা প্রশাসকদের মধ্যে যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর হয়েছে, এমন ২২ জনকে তখন বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিলো। আর ২৫ বছর পূর্ণ না হওয়ায় ৪৩ জনকে ওএসডি করা হয়েছিলো।
মূলত আওয়ামী লীগের সময়ে হওয়া নির্বাচনগুলোর ডিসি-এসপিদের নিয়ে তীব্র আপত্তি রয়েছে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে দলটির একটি প্রতিনিধি দল গত ২৩ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত না করার দাবি জানান।
স¤প্রতি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত তিন নির্বাচনে ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা ছিল, এমন কেউ আগামী নির্বাচনে থাকতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, উচ্চ পর্যায়ের ওই বৈঠকে যে বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে তা হলো- মাঠ প্রশাসনে গত তিন নির্বাচনে ডিসি, এডিসি, ইউএনও ও যারা ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন বা যারা ম্যাজিস্ট্রেট রোলে ছিলেন তাদের যাতে কোনো পদায়ন না হয়।
সরকারের দিক থেকে গত তিন নির্বাচনে ‘ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা’ থাকলেই যে আগামী নির্বাচনে অযোগ্য হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে প্রশাসনের ভেতরে ও বাইরে।
ইউএনও হিসেবে সহকারী রিটার্নিং অফিসার ছিলেন ২০১৮ সালের নির্বাচনে এমন কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, নির্বাচনে তারা সরকারি নির্দেশের বাইরে গিয়ে কিছু করেননি এবং কোনো অনিয়মেও সংশ্লিষ্ট হননি।
‘একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব না দিতেই পারে। কিন্তু ঢালাও ট্যাগ দেওয়া অবমাননাকর। তখন সরকারি দায়িত্ব পালন না করার সুযোগ আমাদের ছিল না। অনেকে হয়তো রাজনীতিতে জড়িয়েছেন কিন্তু অনেকে জড়াননি, সেটিও বিবেচনায় থাকা উচিত,’ বলছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা।
গত ২৩ অক্টোবর বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠকে প্রশাসন ও সরকারি বিতর্কিত কর্মকর্তাদের সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখতে বললেও ঢালাওভাবে সব কর্মকর্তাদের কথা কিছু বলেননি।
বরং বৈঠকের প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, অতীতের সব প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে নতুনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করা বাস্তবসম্মত নয়, বরং তাদের মধ্যে যারা অতীতে চাপ বা ভয়ের কারণে অন্যায় করেছে, তাদের এখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করতে হবে।
বিশ্লেষকরাও বলছেন, অভিযোগ থাকলে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া উচিত এবং সেটি না করে ঢালাওভাবে কর্মকর্তাদের দোষারোপ করার মাধ্যমে আমলাতন্ত্রে নতুন বিভাজন তৈরি হচ্ছে, যা আমলাতন্ত্রকে দুর্বল করবে কিংবা নতুন সুবিধাভোগী শ্রেণী তৈরি করতে সহায়তা করবে।
সাবেক যুগ্ম সচিব বিজন কান্তি সরকার বলেন, পক্ষপাতিত্ব ছিল এমন বিতর্কিত কর্মকর্তাদের যদি চিহ্নিত করা যায় সেটা উত্তম। বড় বড় পদে ছিল এমন বিতর্কিতদের বাদ দেওয়া উচিত। তবে আমি ঢালাওভাবে বাদ দেওয়ার পক্ষে নই। কারণ তাহলে কাজ করবে কে? এত কর্মকর্তা আমাদের তো নেই।
নির্বাচন কমিশন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য চূড়ান্ত ভোটকেন্দ্রের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, মোট ৪২ হাজার ৭৬১টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হবে। আর এসব কেন্দ্রে মোট ভোটকক্ষ থাকবে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৭৩৯টি।
বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ হলো রিটার্নিং অফিসার। সাধারণ সরকারের জেলা প্রশাসক কিংবা উপ-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। সিটি কর্পোরেশন এলাকাসহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভাগীয় কমিশনাররাও এই দায়িত্ব পেয়ে থাকেন।
নির্বাচন কমিশনের নীতিনির্ধারণী কাজ তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। তারাই মনোনয়ন বাছাই, মনোনয়ন বাতিল, প্রার্থীর বৈধতা কিংবা প্রতীক বরাদ্দ, পুরো ভোট প্রক্রিয়া তত্ত¡াবধান করেন। এছাড়া প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের তালিকা তৈরি ও ভোটকেন্দ্র নির্বাচনের দায়িত্বও থাকে তাদের ওপর।
আর সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। তবে কিছু এলাকায় জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা এ দায়িত্ব পালন করেন। প্রার্থীদের সাথে যোগাযোগ, প্রিজাইডিং অফিসার কারা হবে, ভোটের দায়িত্ব কারা পালন করবে, এসব বিষয়ে তারা রিটার্নিং অফিসারকে সহায়তা করেন।
আবার নির্বাচনে কেন্দ্রপ্রধান হিসেবে করেন প্রিসাইডিং অফিসার। সাধারণত সরকারি কলেজের শিক্ষক, ব্যাংকের ম্যানেজার, সরকারি হাই স্কুলের প্রধান বা সমমনা শিক্ষক কিংবা কলেজের শিক্ষকরা এই দায়িত্ব পেয়ে থাকেন।
প্রিসাইডিং অফিসারের অধীনে কাজ করেন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার। একটি কেন্দ্রের প্রতিটি ভোটকক্ষের দায়িত্বে থাকেন একজন করে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার।
আবার সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে সহায়তার জন্য প্রতিটি ভোটকক্ষে দুজন করে পোলিং অফিসার থাকেন। সাধারণত স্থানীয় স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষক বা সমমানের কর্মকর্তারা এই দায়িত্বের জন্য বিবেচিত হন।
অন্যদিকে আইন শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে জেলার মূল দায়িত্ব থাকে পুলিশ সুপারের হাতে এবং তিনি তখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে কাজ করেন। তবে সেনাবাহিনী মোতায়েন হলে তারা রিটার্নিং অফিসারের তত্ত¡াবধানে কাজ করে থাকেন।