আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারছেন না প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশী। এর মধ্যে চট্টগ্রামের রয়েছে প্রায় ৮ লাখ। ১০ বছর আগে আইন সংশোধন হলেও তা কার্যকর করা হয়নি এখনো। ফলে প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ ও চরম হতাশা বিরাজ করছে। এদিকে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে দেশে আসছেন অনেক প্রবাসী।
জানা যায়, বিশ্বের ১৬০টি দেশে অন্তত দেড় কোটি বাংলাদেশী অবস্থান করছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিসহ নানা কর্মকান্ডে লিপ্ত তারা। এদের মধ্যে ৫০ লাখ প্রবাসীর দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকলেও এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশের নাগরিক। এই এক কোটি নাগরিক এবারও ভোটাধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন।
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি রেমিটেন্স। যারা জীবনবাজি রেখে, পরিবার, সংসার সবকিছুর মায়া ত্যাগ করেছেন, তারা দেশের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।
প্রবাসীরা জানান, বিভিন্ন দেশে বসবাসরতরা যাতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেজন্য আইন সংশোধন করা হয়েছে ৮ বছর আগে। এরমধ্যে দুটি জাতীয় নির্বাচন ও বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কোনো নির্বাচনেই তারা ভোট দিতে পারেননি।
জানা গেছে, বিপুলসংখ্যক প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে নির্বাচন বিধিমালায় সংশোধনী আনে নির্বাচন কমিশন।সংসদে আইন পাস হয়। ওই বছরের ২০ ডিসেম্বরে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের আইনে সম্মতি দিয়ে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান। ওই আইনে বলা আছে, ‘কোনো বাংলাদেশী নাগরিক বিদেশে বসবাস করলে তিনি দেশে সর্বশেষ যে নির্বাচনী এলাকা বা ভোটার এলাকায় বসবাস করেছেন অথবা তার নিজের বা পৈত্রিক বসতবাড়ি যেখানে ছিল বা রয়েছে; তিনি সেই এলাকার অধিবাসী বলে গণ্য হবেন।’
সে সময় ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এখন থেকে সকল নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন প্রবাসীরা। প্রবাসীরাও আশান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু এরপর ৮ বছর কেটে গেলেও আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি তাদের।
প্রবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের ভোটার করার জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন। বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা নির্বাচন কমিশন ও সরকারের নিকট দফায় দফায় স্মারকলিপিও প্রদান করে।
আবুধাবী বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ইফতেখার হোসেন বাবুল বলেন, প্রবাসীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা উপার্জন করে দেশে পাঠায়। তাদের পাঠানো রেমিটেন্সে দেশের উন্নয়ন হয়, রিজার্ভ বাড়ে কিন্তু তাদের মূল্যায়ন করা হয় না। ভোটাধিকার প্রয়োগ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। এ অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয় না। আপনা আপনিই পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা পাচ্ছি না। তিনি বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি জানিয়েছিলাম। হয়ত কোন জটিলতার কারণে হয়নি। এবার না হোক ভবিষ্যতে যারা আমরা ভোট দিতে পারি সে ব্যবস্থা করতে হবে।
সূত্র জানায়, বর্তমান ইসি রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের সঙ্গে যে সংলাপের আয়োজন করেছে, তাতে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা প্রবাসীদের ভোটাধিকার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। অবশ্য এর আগে পরিকল্পনা পর্যায়ে ইসির কাছে প্রস্তাব এসেছিল, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে কমিশন ভোটার আবেদন ফরম পাঠাবে। দূতাবাস থেকে সে দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা ফরম সংগ্রহ করে তা পূরণ করে আবার দূতাবাসেই জমা দেবে। এরপর দূতাবাস বাংলাদেশে তাদের স্থায়ী ঠিকানা অনুযায়ী জেলাভিত্তিক প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করে পাঠাবে ইসির কাছে। ইসি জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার মাধ্যমে তা যাচাই-বাছাই করবে। কিন্তু তা আর হয়নি।
নির্বাচন কমিশনের মতে, আইন সংশোধন হলেও প্রয়োজনীয় বিধিমালা করার কাজটি এখনও এগোয়নি। তবে প্রবাসীদের কীভাবে ভোটার করা হবে তা নিয়ে ভাবা উচিত। তারা বলেন, কয়েকটি দেশের দূতাবাসে পাসপোর্ট করার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু একই কায়দায় জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া কঠিন।
তাদের মতে, ভোটারদের তথ্য যাচাইয়ের জন্য সব ডাটা দেশে এনে তথ্যভান্ডারে যাচাই করতে হবে। তারপর ভোট দেয়ার প্রসঙ্গ আসবে। তবে ৩০০ আসনের ব্যালট পেপার, প্রয়োজনীয় ব্যালট বাক্সসহ নানা কারিগরি ও সামগ্রি প্রতিটি দেশে সরবরাহ প্রায় অসম্ভব।
ফটিকছড়ির বাসিন্দা যুক্তরাস্ট্র প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা মো. শাহজাহান বলেন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেয়া অবশ্যই প্রয়োজন। এটা তাদের নাগরিক অধিকার। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উচিৎ এ ব্যাপারে পদেক্ষপ নেয়া। প্রবাসীরা উন্নয়নের অশশীদার। বিয়য়টিও ভাবা দরকার।
তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রবাসীদের হিস্যা এখন প্রায় ৮ শতাংশ। সর্বশেষ অর্থবছরে প্রবাসীরা প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রাণই হচ্ছে প্রবাসীদের আয়। প্রায় অধিকাংশ প্রবাসীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বিনিয়োগ আছে দেশে।
ফ্রান্স প্রবাসী সাংবাদিক দেবেশ বড়ুয়া বলেন, প্রবাসীরা দেশের সুনাম বিশ্বে তুলে ধরছে। রেমিটেন্স পাঠিয়ে উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। অথচ তাদের ভোটার করা হচ্ছে না। তাদের কেন ভোটাধিকার বঞ্চিত করা হবে ? বিষটি সরকারের ভাবা দরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্বের ১২০ দেশে তদের প্রবাসী নাগরিকদের বিভিন্নভাবে ভোটাধিকারের ব্যবস্থা রয়েছে। যার মধ্যে আছে এশিয়ার ২০টি দেশও।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই ভোট দিতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকরা যদি ভোট না দেন সেক্ষেত্রে তাদের জরিমানা করার ব্যবস্থা আছে। জাপানি নাগরিকরাও ভোট দিতে পারেন। কানাডার নাগরিকদের ভোটাধিকার রয়েছে। ফিলিপাইনও তার প্রবাসী নাগরিকদের জন্য ভোটের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। হংকং, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরেও আছে অপটিক্যাল স্ক্যানিং ভোটিং সিস্টেম।
আবুধাবী বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নাছির তালুকদার বলেন, এত পরিশ্রম করে দেশকে এগিয়ে নেয় প্রবাসীরা অথচ তারা ভোট দিতে পারে না। যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারে না। এটা দুঃখজনক। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু কোন কারণে কার্যকর হয়নি। তিনি প্রবাসীদের ভোটার করার ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানান।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হাটহাজারীর নিজাম আব্দুর রহিম বলেন, প্রবাসীদের ভোটাধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া দরকার। দেশের এক কোটি নাগরিক ভোটাধিকার বঞ্চিত থাকবে সেটা মেনে নেয়া যায় না।
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচারণা চালাতে দেশে আসছেন শত শত প্রবাসী। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতাই বেশি। ফটিকছড়ির বাসিন্দা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা মো. শাহজাহান, হাটহাজারীর নিজাম আব্দুর রহিমও দেশে এসেছেন অনেক আগেই।
এরই মধ্যে নৌকার পক্ষে প্রচারণা চালাতে দেশে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক, সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক ঢামেকসু ভিপি ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া, স্পেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রিজভী আলম। সুইডেন যুবলীগের আহব্বায়ক জুবাইদুল হক সবুজ, যুক্তরাষ্ট্র ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদ হাসান, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, জার্মান আওয়ামী লীগের সভাপতি বশিরুল আলম চৌধুরী সাবু, ফ্রান্স আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজির আহমেদ সেলিম, সহ-সভাপতি এমএ কাশেম, পর্তুগাল আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রফিকউল্লাহ এসেছেন দেশে।
এছাড়াও ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল দাশ গুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক এমএ গনি, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফ, ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুজিবর রহমান, স্পেন আওয়ামী লীগের সভাপতি আখতার হোসেন আতা, বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল হক, নেদারল্যান্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন তপন, ফ্রান্স আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মঞ্জুরুল হাসান চৌধুরী সেলিম ও প্রবাসী সাংবাদিক দেবেশ বড়ুয়া দেশে আসার কথা রয়েছে।
বিভিন্ন দেশ থেকে বিএনপি, যুবলীগ নেতারাও দেশে এসেছেন। আরও অনেকে আসার পথে রয়েছেন।