ভোজ্যতেল সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ভোক্তারা

6

ফারুক আবদুল্লাহ

নিত্যপণ্য ভোজ্যতেলের সিন্ডিকেটের কাছে একপ্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ ভোক্তারা। যখন ইচ্ছা তখন বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বোতলজাত সয়াবিন তেল বাড়ানো হচ্ছে। গত দুই মাস আগেও বাজার থেকে তেল গায়েব করে লিটারপ্রতি ৮ টাকা বাড়ানো হয়। এবার রমজান মাসকে টার্গেট করে আবারও দাম বাড়াতে বাজারে সয়াবিন তেলের মারাত্মক সংকট তৈরি করেছে প্রভাবশালী এই সিন্ডিকেট।
অথচ দেশে ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে পর্যাপ্ত। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যাপ্ত বেড়েছে। একই হারে বেড়েছে ঋণপত্রও (এলসি)। এরপরও কোন কারণ ছাড়াই বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট বিরাজ করছে।
তথ্যমতে, দেশে প্রতিবছর ভোজ্যতেলের চাহিদা ২৩-২৪ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে তেল উৎপাদিত হয় আড়াই লাখ টন। বাকি ২০-২১ লাখ টন ভোজ্য তেল আমদানি করা হয়। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টন।
ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ১০ লাখ ৯৫ হাজার ৫২৫ টন সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৮০ টন ও পাম তেল ৭ লাখ ১১ হাজার ৪৪৪ টন। এর মধ্যে গত নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৩২ হাজার টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৯ শতাংশ বেশি। এছাড়া গত জানুয়ারিতে সয়াবিন বীজ আমদানি হয়েছে ৩ লাখ টন। গত এক বছরে এত বেশি সয়াবিন বীজ আমদানি হয়নি।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন মোকাম ঘুরে ভোজ্যতেলের তীব্র সংকটের চিত্র দেখা গেছে। এসব মোকামে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে খুব কম। সংকটের কারণে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বোতলজাত সয়াবিন তেল।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, রূপচাঁদা ব্র্যান্ড ছাড়া কোন কোম্পানি মাল ক্রয়ের রশিদ দিচ্ছে না। এসব কোম্পানি সাদা কাগজে মাল ক্রয়ের হিসেব লিখে দিচ্ছে। এছাড়া চাহিদার তুলনায় মাল সরবরাহ দিচ্ছে খুব কম। নির্ধারিত ক্রেতাদের মাল না দিয়ে বেশি দামে বাইরে বিক্রি করছে কোম্পানির ডিলাররা।
চাক্তাই এলাকার রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের ডিলার এর ম্যানেজার শ্যামল বলেন, মাঝখানে প্রোডাক্ট সংকট ছিল। এখন মোটামুটি কিছুটা সংকট কমছে। বলতে গেলে চাহিদা তুলনায় ৬০ শতাংশ পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবে। কোম্পানির নাকি বর্তমান দামে পোষাচ্ছে না। এছাড়া আমরা রশিদ ছাড়া পণ্য বিক্রি করি না।
একইভাবে খাতুনগঞ্জ এলাকার পুষ্টি ব্র্যান্ডের ডিলার সাতকানিয়া স্টোরের ম্যানেজার আবছার জানান, কোম্পানি থেকে ২-৪ দিন পর এক গাড়ি মাল পাচ্ছি। যা পাচ্ছি কোম্পানির নির্ধারিত দামে আমরা বিক্রি করছি। বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে না। আশা করি এই সপ্তাহ কিংবা আগামী সপ্তাহে সংকট পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
এছাড়া নগরীর বহদ্দারহাট ও চকবাজারে সরেজমিন দেখা গেছে, এখানকার খুচরা দোকানগুলোতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের তীব্র সংকট চলছে। দোকানিরা বলছেন, ডিলার ও কোম্পানির প্রতিনিধিদের দেখা মিলছে না। অর্ডার দিয়েও চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে গত সোমবার বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন গণমাধ্যমকে বলেন, ভোজ্যতেলের অস্থিরতা নিরসনে কাজ করছে সরকার। বন্দর থেকে শুরু করে খাতুনগঞ্জ সবখানেই তেলের মজুদ যাচাই-বাছাই ও মনিটরিং চলছে। এক সপ্তাহের মধ্যে ভোজ্যতেলের অস্থিরতা কেটে যাবে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা আরও বলেন, পবিত্র রমজান উপলক্ষে ফ্যামিলি কার্ডের বাইরে সারাদেশে টিসিবি ট্রাক সেলের মাধ্যমে আটটি বিভাগীয় শহর ও পাঁচ জেলায় অতিরিক্ত ৯ হাজার টন পণ্য ১২ লাখ পরিবারের কাছে বিক্রি করা হবে। এতে বাজার পরিস্থিতি সহনীয় থাকবে। টিসিবি বর্তমানে ৬৩ লাখ পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য সরবরাহ করে।
ক্যাবের কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে সাধারণ মানুষের পকেট কাটার জন্য। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলছেন কোন সমস্যা হবে না, কিন্তু সমস্যা তো আমাদের।
তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, রিফাইনারিগুলোতে, ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের আড়তে কী পরিমাণ তেল আছে সেটা মনিটরিং করে বের করা হোক। তাদের কাছে মজুদকৃত তেল বাজারে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কারণ, যে পরিমাণ ক্রুড আমদানি হয়েছে, তারা তো সেগুলো রেখে দেওয়ার জন্য আমদানি করেনি। এছাড়া বসুন্ধরা এবং এস আলমের কারখানাগুলো সরকারি হস্তক্ষেপে সচল করার উদ্যোগ নিলে আশা করি বাজারে চলমান সংকট স্বাভাবিক হয়ে যাবে।