ভোক্তার সচেতনতা ও আস্থা বেড়েছে

21

বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে ভোক্তার মাঝে সচেতনতা বেড়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা ও অপকৌশলের কারণে প্রতিনিয়ত ভোক্তারা ঠকলেও কোথাও পাওয়া যেতো না প্রতিকার। তবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তৎপরতায় গত কয়েকবছরের মধ্যে ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতার হার বেড়েছে। ভোক্তারা অবৈধ ব্যবসায়িক তৎপরতা দেখলে তাৎক্ষণিক অভিযোগ করছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে। অবশ্য সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে দপ্তর কোনো পদক্ষেপ নিলে ভোক্তা নিজেও সেখানে লাভবান হচ্ছেন।
অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ৬ এপ্রিল ২০১১ সালে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। তিনবছর পর ২০১৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে যাত্রা শুরু হয় চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের। চট্টগ্রাম বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়ের অধীনে বাজার তদারকি ও ভোক্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছরের ২৯ ফেব্রূয়ারি পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৭৫১টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ১ হাজার ৭২৫টি অভিযান পরিচালনা করে মোট ৪ কোটি ৮৫ লাখ ৩ হাজার ৬৫০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। দপ্তরের কার্যক্রম বছরে বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। সীমিত সংখ্যক লোকবল থাকলেও দপ্তরটি তাদের দক্ষতা দেখিয়েছে শুরু থেকেই। ২০১৫ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি তাদের গতিময়তা পায়।২০১৫-১৬ অর্থবছরে দপ্তর ৩৯টি অভিযানে ১৯৫টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পরের অর্থবছরে ২২১টি অভিযানে ৫৫০টি প্রতিষ্ঠানকে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৫০টি অভিযানে ৫৭৯টি প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করা হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অভিযান আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৭টিতে। এবছরে ১ হাজার ৬৫টি প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করা হয়। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০ অসমাপ্ত) ফেব্রূয়ারি পর্যন্ত ৫১০টি অভিযানে ৭১৮টি প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত করা হয়। এসব অভিযানে নানামুখী ক্রেতা বা ভোক্তা ঠকানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। যার কারণে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয় ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে কথা হলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সীমিত লোকবল নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের কাজ প্রশংসনীয়। সরকারের অনেক সংস্থা বা দপ্তরের মধ্যে এ দপ্তরটি ব্যতিক্রমী ভূমিকা রেখেছে। তারা ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ভোক্তাদের মধ্যে নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করায় ভোক্তা সচেতনতা বেড়েছে। ভোক্তারা এখন অন্যায় দেখলে অভিযোগ করছেন।
এদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়ে গত ফেব্রæয়ারি মাস পর্যন্ত মোট ২ হাজার ১২৭টি অভিযোগ জমা পড়ে। এরমধ্যে ২ হাজার ৪৭টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়। নিষ্পত্তি হওয়া অভিযোগগুলোর বিপরীতে মোট ৩৭ লক্ষ ৭৮ হাজার ২০০ টাকা জরিমানা আদায় করে অভিযোগকারীদের মধ্যে ৯ লক্ষ ৩১ হাজার ৭৫০ টাকা প্রদান করা হয়। ভোক্তা অধিকার আইনের ধারা ৭৬ (৪) ও (৫) অনুসারে অভিযোগের প্রেক্ষিতে জরিমানা করা হলে সে জরিমানার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী প্রাপ্ত হন। তবে ধারা ৭৬ অনুযায়ী, অভিযোগকারী অধিদপ্তরের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী হলে অথবা অভিযান চলাকলে টিমের সদস্য হলে আদায়কৃত জরিমানার অংশ প্রাপ্য হবেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, অসাধু কার্যক্রমের মাধ্যমে ভোক্তাকে ঠকানোর প্রবণতা রোধ করতে আমরা সবসময় সচেষ্ট আছি। অভিযানের মাধ্যমে আমরা ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছি। দিনে দিনে ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা বা অভিযোগ করার প্রবণতা বেড়েছে।
তিনি বলেন, নিয়মিত বাজার তদারকিমূলক অভিযান পরিচালনা করা হয়। আবার অভিযোগের ভিত্তিতেও অভিযান পরিচালনা করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কোনো অনিয়ম পেলে অসাধু ব্যবসায়ীদের আমরা ছাড় দিচ্ছি না। নকল, ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বা ওষুধ, ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে কোনো ওষুধ, পণ্য বা সেবা বিক্রয়, ওজনে বা পরিমাপে কম দেয়ার মতো ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্যক্রম প্রতিরোধ করা হচ্ছে।
ভোক্তা অধিদপ্তরে জমা পড়া অভিযোগ ও বাজার তদারকিমূলক কার্যক্রমে ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রি করা, ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা, খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারিত করা, ওজনে কারচুপি, বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপি, মেয়াদ উত্তীর্ণ কোনো পণ্য বা ওষুধ বিক্রি, কাঙ্খিত পণ্য বা সেবা না দেয়ার মতো অভিযোগ বেশি পাওয়া যায়।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণেই ভোক্তারা ঠকছেন। ঠকার পরেও ভোক্তারা আইনের আশ্রয় নেওয়ার মতো জায়গার অভাব ছিলো। তবে অধিদপ্তরের বিভিন্ন কার্যক্রমে ভোক্তারা দিনে দিনে সচেতন হচ্ছেন। তারা তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে অভিযোগ করছেন। আর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সুফলও পাচ্ছেন।
এদিকে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। বিশিষ্ট পরিবেশবাদী ও ভোক্তাদের অধিকার বিষয়ে আন্দোলনে সোচ্চার কর্মী মালয়েশিয়ার আনোয়ার ফজল কর্তৃক এ দিবস পালনের রূপকার হিসেবে পরিচিতি হয়েছেন। ১৫ মার্চ, ১৯৮৩ তারিখে তিনি ভোক্তা সংগঠনগুলোর মাধ্যমে ভোক্তাদের মৌলিক অধিকার সম্বন্ধে সচেতনতার উদ্দেশ্য বৈশ্বিকভাবে উদযাপনের আহব্বান জানান। তারও আগে ১৫ মার্চ, ১৯৬২ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি কংগ্রেসে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে বক্তৃতা দেন। তিনি নিরাপত্তার অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং অভিযোগ প্রদানের অধিকার- ভোক্তাদের এ চারটি মৌলিক অধিকার সম্পর্কে তিনি আলোকপাত করেন যা পরবর্তীতে ভোক্তা অধিকার আইন নামে পরিচিতি পায়। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে জাতিসংঘ ভোক্তা অধিকার রক্ষার নীতিমালায় কেনেডি বর্ণিত চারটি মৌলিক অধিকারকে আরো বিস্তৃত করে অতিরিক্ত আরো আটটি মৌলিক অধিকার সংযুক্ত করা হয়। এরপর থেকেই কনজ্যুমার্স ইন্টারন্যাশনাল এ সকল অধিকারকে সনদে অন্তর্ভুক্ত করে। কেনেডির ভাষণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৫ মার্চকে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী উদযাপন করে আসছে।