ভেজাল ভেজাল ফরমালিনও ভেজাল

2

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

অনেক ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং স্কুল কলেজে কোচিং সেন্টারে অনেক ধরনের সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। কিন্তু মনুষ্যত্ব ও নীতি নৈতিকতার সার্টিফিকেট কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। একজন শিক্ষকের কাছে থাকা প্রশ্নপত্র যদি পরীক্ষার আগেই ফাঁস হয়ে যায় ধরে নিতে হবে পুরো জাতির পচন ধরছে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের হাতে যদি ছাত্রী যৌন নিপীড়নের স্বীকার হয় এসব শিক্ষকের নিকট জাতি ঋণী থাকবে ?
সমগ্র পৃথিবীর দ্রুত উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু নৈতিক অধপতন হচ্ছে। মাছ ভেজাল, সবজি ভেজাল, চাল ভেজাল, মাংস ভেজাল, ডাল ভেজাল, ভেজাল খেয়ে ঔষধ খাবেন ? তাও ভেজাল। পরিবেশ ভেজাল, রাজনীতিক ভেজাল, বুদ্ধিজীবী ভেজাল, আইনজীবী ভেজাল, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ভেজাল। ডাক্তার সাহেব আমাকে বললেন, ফরমালিনও ভেজাল হয়ে গেছে। আমি জানতে চাইলাম, ফরমালিন কীভাবে ভেজাল হলো ? ডাক্তার জানালেন, ফরমালিনের একটা ভালো দাম আছে, দামী ফরমালিন ব্যবহার করলে পণ্যে লাভ করা যায় না, তাই লাশ পচে না যে ক্যামিকেল ব্যবহার করলে সে ক্যামিকেল ফরমালিনের পরিবর্তে ব্যবহার হচ্ছে। সবখানে যখন ভেজাল তখন ভেজালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ভেজাল মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। ভেজাল মানুষের সংখ্যা কমাতে হবে, ভালো মানুষের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তা না হলে শত চেষ্টাও ভেজাল মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। ধরুন দুর্নীতি দমনের জন্য দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ সংস্থা করলেন। তারা যদি দুর্নীতি করে, তাদের দুর্নীতি দমনের জন্য আরেকটি সংস্থা গঠন করতে হবে। তারাও যদি দুর্নীতি করে তাদের দুর্নীতি দমনের জন্য আরো একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতে দুর্নীতি ও দুর্নীতি প্রতিরোধ সংস্থার সংখ্যা বাড়তেই থাকবে, কমবে না।
ছোটবেলায় একটি গল্প শুনেছিলাম। তাও শুনাতে চাই। রাজাকে এক গোয়াল প্রতিদিন এক লিটার দুধ দিতো, এক উজির রাজাকে বললো, জাঁহাপনা ! গোয়াল দুধে পানি মিশ্রন করে। রাজা উজিরকে বললো, যাও আজ হতে তুমি পরীক্ষা করে দেখবে, দুধে পানি দেয় কি না। উজির গোয়ালকে বললো, তোমার দুধ খাঁটি কিনা রাজা আমাকে পরীক্ষা করে দেখার দায়িত্ব দিয়েছেন। গোয়াল বললে আমার দুধ শতভাগ খাঁটি। উজির বললো, খাঁটি হলেও আমি রাজাকে রিপোর্ট করবো তোমার দুধ ভেজাল। গোয়াল বললো, আমাকে কী করতে হবে ? উজির বললো, কিছু দুধ তুমি আমাকে দিয়ে দিবে আর বাকি দুধে কিছু পানি মিশ্রন করবে। তখন আমি রিপোর্ট করবো তোমার দুধ খাঁটি। তাই করা হলো, রাজা দুধ পান করতে গিয়ে বুঝতে পারলো, আগের চেয়েও দুধ পাতলা হয়ে গেছে। রাজা ভেজাল ধরতে একে একে তিন জন লোক পাঠালো। তিনজন মিলে ৭৫ ভাগ দুধ নিয়ে যায়। রাজার দুধে ৭৫ ভাগ পানির সমাহার হলো। রাজা দুধে চিংড়ি মাছের পোনা পেল। গোয়ালকে তলব করে জানতে চাইলো, দুধে কী করে চিংড়ি মাছের পোনা এলো। গোয়াল বললো জাঁহাপনা দুধে চিংড়ি মাছের পোনা নয়, আর কিছু দিন পর দুধে কাদা আসবে। কারণ এই যে দুর্নীতি দমনের জন্য লোক নিয়োগ করছেন তারা ৭৫ ভাগ দুধ ভাগ করে নিয়ে গেছে। আমি জমি হতে ৭৫ ভাগ পানি মিশ্রণ করতে গিয়ে পানির সাথে চিংড়ি মাছের পোনা এসেছে। আশা করি গল্পটির বাস্তবতা ও সারাংশ আত্মস্থ করতে পারবেন।
যে দেশে নিউ মার্কেট মোড়ে হাজার মানুষের সামনে ট্রাফিক সার্জেন ঘুষ গ্রহণ করে সে দেশের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করবে কী করে। সরকারি ৯৫ ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি করে। বিচার হয় এক হাজারে একজনের। এত বড় নীতিহীন জাতির আইন দিয়ে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা কী সম্ভব ? কখনো লয়।
এক সময় বলা হতো, ‘ When money is lost, nothing is lost, when heath is lost, Something is lost; when characters is lost everything is lost. ’ এখন দেখি অর্থের লাভ ও লোভে সব কিছু মানুষ বিসর্জন দিতে রাজি। মানুষ এখন ভাবে characters is lost nothing is lost.
অর্থের স্বার্থে, লাভ ও লোভের কারণে বেঁচে থাকার পণ্য খাদ্যে ভেজালের উৎসবে মিলিত হয়েছি। অজ্ঞ লোভী মানুষ বুঝে না, খাদ্য ভেজারের কারণে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই বিষয়ে একটা গল্প বলতে চাই। দুই শিক্ষিত বন্ধু গ্রামের পথে হাঁটছে। এক স্থানে তারা পথের পাশে দেখতে পেল গোবরের টাল। একজন বললো, বন্ধু! তুমি যদি এক মুষ্টি গোবর খেতে পারো তাহলে আমার নিকট যে ২০ হাজার টাকা আছে তা দিয়ে দিবো। সে ভাবছিল ২০ হাজার টাকার জন্য গোবর খাবে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে গোবর খেয়ে ২০ হাজার টাকা জিতে নিল। দুইজন আরো কিছু পথ অতিক্রম করার পর আরেকটি গোবরের টাল দেখলো। এবার দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রথম ব্যক্তিকে বললো, তুমি যদি এক মুষ্টি গোবর খেতে পারো আমি তোমাকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে দিবো। একথা শুনে প্রথম ব্যক্তি ভাবলো, যে ২০ হাজার টাকা গেল সে ২০ হাজার টাকা উদ্ধার করা প্রয়োজন। তাই সেও গোবর খেয়ে ২০ হাজার টাকা ফিরে পেল। তারপর একজন বললো, কারো কোন লাভ হলো না, আমরা শুধু শুধু গোবর খেলাম। আজ সমাজে আমি খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে আমার লাভের জন্য। আমি যে খাদ্য অন্যজন হতে কিনে খাচ্ছি তাতে সে ভেজাল দিচ্ছে তার লাভের জন্য। এই ভেজালের উৎসবে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি এবং আমাদের সন্তান যারা আগামীর বাংলাদেশ, যাদের মাধ্যমে আমরা বেঁচে থাকবো তাদের ধ্বংস করছি। লাভ কিছু হচ্ছে না, আমরা শুধু শুধু গোবর খাচ্ছি।
আমরা দিনের আলোতে টেক্সী চালাতে পারি না, রাতের আঁধারে ইয়াবা বিক্রি করতে পারি। আমাদের কৃষি কাজ করতে লজ্জা হয়, দেশের সম্পদ চুরি করতে, বিদেশে টাকা পাচার করতে লজ্জা লাগে না। পণ্যে ভেজাল করতে পারি, ঝাড়ুদার, জুতা পালিশের কাজ, নরসুন্দরের কাজকে অভদ্র মনে করি, অথচ এসব কাজের দ্বারা অভদ্রকে ভদ্র করে। নাসার বিজ্ঞানী সুইপার হলে তাদের লজ্জা হয় না, বিল গেটস নিজের গাড়িতে তেলভর্তি করলে তাঁর লজ্জা হয় না, আমাদের কাজে লজ্জা লাগে। যে সব কাজে লজ্জা হওয়ার কথা সে সব কাজে আমাদের লজ্জা হয় না। যেসব কাজে লজ্জা নেই, সেসব কাজে আমাদের লজ্জা লাগে, হয়রত ওমর (রা.) বলেছেন, ‘দিনের আলোকে এমন কাজ করো না, যাতে রাতের ঘুম নষ্ট হয়, আর রাতে আঁধারে এমন কাজ করো না যাতে দিনের আলোতে লজ্জায় চোখ লুকাতে হয়। বর্তমান তো আমাদের লজ্জাই নেই বললে চলে। লজ্জা থাকলে প্রকাশ্য ঘুষ, দুর্নীতি করে গর্ভের সাথে ঘুরে বেড়ায় কী করে। লজ্জা তো ঈমানের অঙ্গ। আমাদের ঈমানের জোর কতটুকু আছে জানি না।
আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডা. মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, ‘ঘুষ যদি টেবিলের উপরে উঠে যায় তাহলে আমার করণীয় কিছুই নেই (যা বেহায়াদের কাজ), আর যদি নিচে থাকে তাহলে এখনই প্রতিরোধ করা সম্ভব। বর্তমান আমাদের জাতীয় জীবনে ঘুষ দুর্নীতি কোথায় অবস্থান করছে তা সবার জানা আছে। অপরাধী ভাবছে, অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে। কখনো নয়, দুনিয়াতেই তার প্রতিদান ভোগ করতে হবে। আপনার মৃত্যু হলে করবে আপনি ভোগ করবেন আর আপনার সন্তানরা ভোগ করবে দুনিয়ায়। শাস্তি হতে মুক্তি নেই। বৃটিশ আমলে রাষ্ট্র ছিল শোষণের হাতিয়ার আর মানুষ ছিল উদার। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্র ছিল সাম্প্রদায়িক মানুষ ছিল মোটামুটি মানবিক। মানুষ এত উন্নতির পরও এখন হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর। লোভী মানুষ এখন অল্পতে সন্তুষ্ট নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা লুঠ করে পাচার করে। ঢাকায় ধর্ণাঢ্য ব্যক্তি কুকুরের জন্মদিনে খরচ করে ১০/২০ লক্ষ টাকা।
কোথায় যাচ্ছি আমরা না আলোর দিকে না অন্ধকারে ?

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক