ভেজাল, ভেজাল এবং ভেজাল !

1

বাবুল কান্তি দাশ

বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডে আমরা যারা বসবাস করি আমাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো আমরা ধর্মভীরু। দেশের প্রায় ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ মানুষই ধর্ম পালন করে থাকে। যা পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের উৎকর্ষ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ। এমনতরো ধার্মিক চরিত্র পরিবার সমাজ রাষ্ট্রের সম্পদ বটে। কিন্তু ধার্মিকতার আড়ালে বা মুখোশে পরিবার সমাজ রাষ্ট্রে এর নেতিবাচক ক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় তখন তা হয়ে উঠে অস্তিত্ব বিনষ্টকারী। সর্বোপরি মানব অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। যেকোনো কাজে অন্তরে বাহিরে এক না হলে তা কখনো সফল হয় না। তা ছোট বড় যে কাজই হোক না কেন। যথার্থ ধর্ম পালনকারীর মধ্যে একধরনের জেল্লা দেখা যায়। যা পারিপার্শ্বিকের কল্যাণ ও মঙ্গল কামনায় সর্বোতভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তখন ব্যক্ত হয়ে সমাজের আদর্শ। সকলের কাছে হয়ে উঠেন আদরনীয় ও সম্মানীয়। যাঁকে দেখলে শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয়। তাহলে কেনওবা এতো সংঘাত, বৈষম্য আমাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে? কেনওবা চারদিকে ঠগবাজ, বাটপার, দুর্বৃত্তরা নর্দমার কীটের মতো কিলবিল করছে? হয়ত এর কোনো উত্তর আপাত নেই! একটু গভীরে গিয়ে বিষয়টি ভাবলে এর উত্তর পানির মতো পরিষ্কার হয়ে উঠে। চারদিকে এতো দুর্বৃত্ত, মুনাফালোভী, ভেজালকারী, মজুদদার, সিন্ডিকেট যারা জনজীবনকে দূর্বিষহ করে তুলছে তাদের কি কোনো প্রতিকার নেই। উত্তরে বলব অবশ্যই আছে। মানুষের মাঝে জাগিয়ে তুলতে হবে ত্যাগ সেবার মহিমা। যা শুরু করতে হবে উপর থেকে। কারণ পানি নিচ দিকেই গড়ায়। মস্তকে পচন ধরলে কি আর কিছু করার থাকে ? খুব বেশি মারাত্মক এবং যা মানুষের বাঁচা বাড়ার পথকে রুদ্ধ করছে তা হলো ভয়ংকরভাবে খাদ্যে ভেজাল। যে ভেজালে শিশু পর্যন্ত বাদ যাচ্ছে না। গত কয়েক দশকে দেশে যে হারে প্রাইভেট হাসপাতাল গড়ে উঠছে এবং প্রতিটি জায়গায় যে পরিমাণে রোগীর ভীড় পরিলক্ষিত হচ্ছে তা অনেকটা ভেজাল খাদ্য এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশজনিত কারণে। একবার একটু চোখ বুলিয়ে নিই খাদ্যের ভেজালে। দুধে ফরমালিন, কফিতে তেতুলের গুড়া, মুড়িতে ইউরিয়া, গরুর দুধ বৃদ্ধিতে পিটুইটারি গ্লান্ড ইনজেকশন, মাছে ফরমালিন, শাকসবজি টাটকা রাখতে কপার সালফেট, আম, লিচু, জাম পাকাতে কার্বোহাইড্রেড। খাদ্যে ভেজাল দেয়ার ব্যাপারে আমরা ভীষন সৃজনশীল। প্রায় শৈল্পিক একাগ্রতায় আমরা নিয়ম ভাঙ্গার ধ্যানে মগ্ন। খামারের মুরগিতে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম, লেড আর এন্টিবায়োটিক তো আছেই, মাছের চাষেও তাই ব্যবহার করা হয়। সেই মুরগি আর মাছ কিনে খাচ্ছি আমরা। ফল গাছে থাকতেই হরমোন আর কীটনাশক প্রয়োগ, আম লিচু জাম সংরক্ষণে ফরমালিন। তরমুজের মধ্যে সিরিঞ্জ দিয়ে পুশ করা হয় পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট যাতে করে বেশি লাল দেখায়। ওই যে মাছের কানসা তুলে যেভাবে দেখে সেটার কপি। এখন নারিকেলেও দেয় কিনা জানিনা, যদিও নারিকেল বেশ শক্ত, তারপরও অসম্ভব না। বাংলাদেশে সবই সম্ভব। সুন্দরবনের মধু তেও কেজির পর কেজি চিনি মিশিয়ে নাকি ‘পিওর’ করা হচ্ছে। কলা পাকানো হয় ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে, কফি পাউডারে তেতুলের বিচির গুঁড়ো, কালার যেহেতু একই রকম মিলিয়ে দিলেও তো লাভ আর লাভ । মশলায় ইটের গুঁড়ো, সেটা দিয়ে রান্না করা ঝোল খেয়ে আমি আর আপনি আহ কি ঝাল কি ঝাল করছি আর পরিপাকতন্ত্রের বারোটা বাজাচ্ছি আর হাজার হাজার কোটি টাকার গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ কিনছি। হলুদে মিশিয়ে দিচ্ছে লেড ক্রোমেট, লেড আয়োডাইড, নামে শুনেই তো বুঝা যাচ্ছে কতটা ক্ষতিকর এইসব কেমিক্যালস। মুড়িকে ধবধবে সাদা আর বড় করতে হাইড্রোজ-ইউরিয়া আর আমি আপনি সাদা মনে সাদা বিশ্বাসে সেই মুড়ি কিনে পরিবারকে খাওয়াচ্ছি। দীর্ঘক্ষণ জিলাপি বা চানাচুরকে মুচমুচে রাখতে কি দেয় বলেন তো? পোড়া মবিল। ভাবুন একবার, কি ভয়ঙ্কর কথা। জ্বি, এসব খেয়ে খেয়ে আমাদের শরীরের ইঞ্জিন ক্ষয়ে যাচ্ছে নীরবে। আকর্ষণীয় করতে আইসক্রিম, বিস্কিট, সেমাই, নুডুলস ও মিষ্টিতে কাপড় আর চামড়ায় যে রং ব্যবহার করে সেটা মিশিয়ে দেয়। কাপড় ! মানে পরিধানযোগ্য কাপড়ে যে রং দেয়, সেই রং খাবারের মধ্যে মিশিয়ে দিচ্ছে অবলীলায়। কারণ, ফুড গ্রেড রং কিনতে একটু বেশি টাকা লাগবে তাই। জুসে দিচ্ছে উচ্চমাত্রার প্রিজারভেটিভ, মসল্লার রং বাড়াতে মেটালিক অক্সাইড, সরিষার তেলে ঝাঁঝালো কেমিক্যালস, শুটকিতে কীটনাশক, কসমেটিকস এ ক্যান্সারের উপাদান লেড মার্কারি। আমরা বাংলাদেশিরা আজকাল এতটাই ভেজাল বিশারদ হয়ে গেছি যে, মনে হয় না কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করেও মানুষ এত চিকন বুদ্ধির মালিক হয়। চাল চকচকে করতে ইউরিয়া, পেঁয়াজু জিলাপিতে অ্যামোনিয়াম। মানুষের সুস্থতার সাথে চলছে এক অবিচারের মহোৎসব। বুক কাঁপে না একটুও। কার কি ক্ষতি হবে সেই টেনশন নেই, খাবারে ভেজাল মেশানো আর মানুষের শরীরে সরাসরি বিষ ঢুকিয়ে দেয়া একই কথা। ফুড ইজ এ বেসিক হিউম্যান রাইটস, সবচেয়ে প্রধান মৌলিক অধিকার অথচ এই অধিকার নিয়ে কি নির্লজ্জ ছিনিমিনি খেলা চলছে বছরের পর বছর। ফলের রস তৈরি হয় কেমিক্যালস দিয়ে, বিদেশী মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য, ঔষধ, কেমিক্যালসে নতুন মেয়াদের স্টিকার লাগিয়ে আবার বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। স্যার, এগুলোর তো মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে, এগুলা কি ফেলে দিব? হায়! বেকুব নাকি ফেলবা কেন, স্টিকার চেঞ্জ করে মার্কেটে ছেড়ে দাও। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও আমরা জানি খাবারে এক কণা ওজনও যেখানে কম দেয়া নিষেধ সেখানে একটু মুনাফার জন্যে এমন জীবন ধ্বংসকারী ভেজালের ব্যবহার কতটা পাপ। আসলে আমরা পাপ কি পূণ্য কি তা এখনো বোধে নিতে পারিনি। এতো ধর্ম চর্চা তারপরও না। কোনো ধরনের স্রষ্টা ভীতি বর্তমান সময়ের মানুষের মাঝে নেই! হয়ত আপাত সুখের লাগি তা করে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু তার ভয়ংকর প্রতিশোধ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ভোগ করবে তা আমরা ভেবে দেখি না বা ভাবতেও চাই না। বর্তমান সময়ে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের এতো অবনমন পূর্বে তা কখনো ছিল না। ভেজাল যে কখনো ছিল না তা নয়, ছিল তবে তা বর্তমানের মতো অতো ব্যাপক ও মরণঘাতী নয়। আমরা আসলে সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে অসভ্য হয়ে উঠছি ক্রমাগত। মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে পশুত্বে উন্নীত হচ্ছি। এবং কেন তা হচ্ছে তা নিয়ে আমরা কেউ ভাবছি না। মনে হয় মানব সভ্যতা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। যত না সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তার চেয়ে বেশি পিছিয়ে পড়ছি। ভোগ আর চাহিদার তীব্রতা এত যে প্রবল যা মানুষকে নিয়ত অমানুষে পরিণত করছে। সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে অন্ধ মুনাফার মোহ থেকে বের হয়ে পাপ মুক্ত হবার চেষ্টা করুন আর সরকারের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো ব্যাপক হারে বাজার মনিটর করার সক্ষমতা ও সদিচ্ছা বাড়ানোর বিনীত অনুরোধ থাকলো। আমরা যদি নিজের প্রত্যেকটা অন্যায়ের জন্য নিজেদেরকে কঠোরভাবে শাসন করতে না পারি, তবে আমরা তীর্থ হয়ে উঠতে পারবে না। তীর্থ অর্থাৎ মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারব না। সকলের কথাই শুনতে হবে। যে-কথাই শুনি না কেন মিলিয়ে দেখতে হবে তার মর্মার্থ। দোষ থাকলে সংশোধন করতে হবে বা সংশোধিত হতে হবে, অবশ্য বাইরে ঢেকে রাখতে হবে। কারণ- কাউকে সংশোধনের জন্য কিছু বলতে হলে গোপনীয়ভাবে তাকে বুঝাতে হবে সমবেদনা নিয়ে। অসৎ যা, নিরোধ করতে হবে কায়মনোবাক্যে। তবে যথাসম্ভব বিরোধ সৃষ্টি না করে। কোনও মানুষকে যথাসম্ভব ত্যাগ করব না। খেয়াল রাখতে হবে আমরা পরমস্রষ্টার স্ফুলিঙ্গ। তাঁতেই বিধৃত হয়ে আছে সব। আমরা যদি তাঁর প্রকৃতি হতে বঞ্চিত হই, তাহলে আমাদের জীবন ফুটবে না। তিনি প্রেমময়, প্রাণময়। আমরাও তাই হই। তাঁর সন্তান আমরা। স্রষ্টার জয় মানে, আমি যত লোকের হৃদয় তাঁর জন্য জয় করতে পারবে, তত তাঁর জয় হবে। তাঁর জয় যেন ঘোষণা করতে পারি। তবেই তো সার্থক মনুষ্য জীবন। মানুষের অনেক কিছুই থাকে, কিন্তু ওতে কিছু আটকায় না। যদি সবকিছু তাঁরই স্বার্থ প্রতিষ্ঠায় লাগাই এবং ওতেই লেগে থাকি। নিয়ামক প্রবৃত্তি খারাপ হলে তাতেই মুশকিল হয়ে পড়ে। তবে সৎসঙ্গ ও সৎকর্মের আশ্রয় গ্রহণ করার ফলে মানুষ ভাল-মন্দ, ভুল-ত্রুটি, সুখ-দুঃখ, ওঠা-পড়া ইত্যাদি সব কিছুর ভিতর দিয়েও তাঁর দয়ায় শেষ পর্য্যন্ত তাঁর পথে এগিয়ে যায়। হাজার-হাজার জন্মের কাজ তাদের এক জন্মে হ’য়ে যায়। স্রষ্টার দরবারে যারা আসে ও তাঁর পথে যারা চলতে চেষ্টা করে তাদের প্রারব্ধ আপাতঃ পতন বা অমঙ্গলও উন্নতি ও মঙ্গলের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভাবনার কিছু নেই। তবে আমাদের চলন-চরিত্র যদি যথাসম্ভব নিখুঁত না হয়, তাহলে আমাদের যেমন দুঃখ পেতে হয় তেমনি লোকেরও অপকার হয়। যিশুর কথা- ‘তোমরা পৃথিবীর লবণ, লবণ যদি তার স্বাদ হারিয়ে ফেলে, তাহলে পৃথিবী লবনাক্ত হবে কী ক’রে? অর্থাৎ আমরা যদি আমাদের বৈশিষ্ট্য অনুপাতে না চলি তাহলে দুঃখ ভোগ করতে হবে এবং তা গড়াবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। আমাদের নিজেদের উপর যেমন অনেক আশা, অপরেরও তেমনি অফুরন্ত প্রত্যাশা। দুর্ব্বলতাকে প্রশ্রয় দেবার অবকাশ কোথায় আমাদের? কোনো কারণে যদিও রেহাই পাই, বেফাঁস চলনে চললে পরিবেশ কিন্তু আমাদের ছাড়বে না। সুতরাং বুঝে চলি। নিজে বাঁচি অপরকেও বাঁচায়। পড়শীরা তোর নিপাত যাবে, তুই বেঁচে সুখ খাবি বুঝি? যা ছুটে যা তাদের বাঁচা তারাই যে তোর বাঁচার পুঁজি। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের লক্ষ্য হউক সপারিপার্শ্বিক বাঁচা বাড়ায় এবং সহযোগে সহভাগে পথচলায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক