ভেঙে চুরমার ‘স্বপ্নের বাঁধ’, লুটেরারা অধরা

4

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘বেড়িবাঁধ ভাঙা মানে আমাদের কলিজা ভাঙা। বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে আমরা বউ-বাচ্চা নিয়ে যাবো কোথায়? আমরা টেকসই বেড়িবাঁধ চাই।’ গত শনিবার বিকালে বাঁশখালীর খানখানাবাদে ভাঙা বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন কদমরসুল এলাকার কামাল উদ্দিন।
বিগত দশ বছর আগেও এই বাঁধের প্রস্থ ছিল প্রায় ৫০ ফুট। সাগরের ভাঙনে এটি ছোট হয়ে গেছে। এই দুর্নীতি হওয়ায় অনেক টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাঁধটি তাড়াতাড়ি ভেঙে গেছে বলে জানান তিনি।
তবে চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের শুরুর দিকে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করা খ. ম. জুলফিকার তারেক পূর্বদেশকে বলেন, ‘সাঙ্গু নদীর মোহনা হওয়ায় নকশা ভুলের কারণেই বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তখনকার সময় নির্মাণ করা বাঁধগুলোর উচ্চতাও কম ছিল।’
‘বাঁশখালী উপজেলার পোল্ডার নং ৬৪/১ এ, ৬৪/১বি এবং ৬৪/১সি এর সমন্বয় ক্ষতিগ্রস্ত অংশের স্থায়ী পুনর্বাসন’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। প্রকল্পটির কাজ শেষ হয় ২০২৩ সালের জুনে। প্রকল্প শেষ হওয়ার পরপরই বাঁধটির ভাঙন দেখা দেয়।
বঙ্গোসাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে গত তিনদিনের টানা বর্ষণে বাঁধটি আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাগরের জোয়ারের পানির উচ্চ ঢেউয়ের তোড়ে বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি বাঁধ টপকেও লোকালয়ে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করেছে। এতে খানখানাবাদের ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গত শনিবার বিকালে পশ্চিম বাঁশখালীর বাহারছড়া পয়েন্ট থেকে প্রেমাশিয়া পর্যন্ত সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বাহারছড়া পয়েন্টে বেড়িবাঁধে বসানো ব্লকগুলো ক্ষয়ে গেছে। কিছু কিছু বাঁধ মাটি ও বালুর সাথে মিশে গেছে। যদিও অন্যান্য এলাকার চেয়ে বাহারছড়ার বাঁধের অবস্থা কিছুটা ভালো আছে। সেদিকটায় বাঁধে ঝাউ বাগানও আছে। খানখানাবাদ এলাকার সৈকত এলাকাটি শেষ হওয়া প্রকল্পের আওতায় ছিল না। সর্বশেষ সেখানে পাথরব্লক বসানো হয়েছে ২০০৯ সালে।
এই পয়েন্টের উত্তরাংশে ব্যাপক ভাঙন হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এই অংশটি দিয়ে জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। বাঁধে ব্লকের উপরেই বালুভর্তি টিউবব্যাগ বসিয়ে পানি ঠেকানো হয়েছে। কদমরসুল সৈকত এলাকার পুরো এলাকা এখনও অরক্ষিত। সেখানে ঝাউগাছ থাকলেও ঢেউয়ের তোড়ে সেগুলোর বেশিরভাগই ভেঙে পড়েছে। কদমরসুলের উত্তরাংশ থেকে ২০১৭ সালে স্থায়ী বেড়িবাঁধের কাজ শুরু হয়। যেখান থেকেই কাজ শুরু হয়েছে সেখানেই বড় ধরনের ভাঙন হয়েছে। সেখানেও বালুভর্তি বিশালাকার টিউবব্যাগ বসানো হয়েছে। এ অংশ থেকে প্রেমাশিয়ার উত্তরাংশ সাঙ্গু মোহনা পর্যন্ত পুরো বেড়িবাঁধে পাথরব্লক বসানো হয়। সেখানে বসানো কয়েকটি ব্লকের গায়ে নির্মাণের তারিখ লিখা আছে।
এতে দেখা যায়, কিছু ব্লক নির্মাণ করা হয়েছে ২০২২ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে। অর্থাৎ খানখানাবাদ বেড়িবাঁধে দুই বছর আগে বসানো ব্লকও ধসে গেছে।
খানখানাবাদ থেকে প্রেমাশিয়ার উত্তরাংশ সাঙ্গুর মোহনা পর্যন্ত পুরো এলাকার বাঁধটির নিচের অংশে ধেবে গেছে। সরে গেছে পাথর ব্লক। এছাড়াও বিভিন্ন অংশে বাঁধ ভেঙে ব্লক সাগরে বিলীন হয়েছে। একটি পয়েন্টে ভাঙন ঠেকাতে নতুন করে বালুভর্তি টিউবব্যাগ বসানো হয়েছে। টিউবব্যাগগুলোর গায়ে লাল রঙে ‘পিডিএল’ লিখা আছে।
টিউবব্যাগে পিডিএল লিখার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, নতুন অনুমোদিত হওয়া বাঁশখালী-আনোয়ারায় ৮৭৪ কোটি টাকার প্রকল্পের খানখানাবাদ অংশে কাজ পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম পিডিএল। এই প্রতিষ্ঠানই বাঁধটি যাতে আর না ভাঙে সেজন্য টিউবব্যাগ বসিয়ে সংস্কার করেছে।
বাঁশখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অনুপম পাল পূর্বদেশকে বলেন, ‘এবার জলোচ্ছ¡াসে সাগর উপকূলে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। যেসব ভাঙন দেখা যাচ্ছে সেগুলো আগের। খানখানাবাদে বালুভর্তি ব্যাগ বসানো হয়েছে। পিডিএল এ অংশে কাজ পেয়েছে। নতুন প্রকল্পে বাঁধে ব্যাগ বসানোর শিডিউল ধরা থাকায় তারাই এই ব্যাগ বসিয়েছে।’
খানখানাবাদের বাসিন্দা নেজাম উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘সাগর থেকে মাটি তুলে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। এই বাঁধে বেশিরভাগ সাগরের বালু ব্যবহার করা হয়েছে। তখন ঠিকাদারের সাথে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা জুটে যাওয়ায় হয়রানির ভয়ে কেউ কথা বলেনি।’
২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর ধরে ২৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁশখালী উপক‚লবাসীর ‘স্বপ্নের বাঁধের’ কাজ চলে। নির্মাণ সময়সহ ধরলে গত ৮ বছওে এ প্রকল্পের সুফলতো মিলেনি উল্টো উপক‚লীয় বাঁধে স্বপ্ন ভেঙেছে। যে কারণে নতুন অনুমোদিত হওয়া প্রকল্প ঘিরে আবারো স্বপ্ন বুনছে বাঁশখালী উপকূলের মানুষ।
লুটেরারা অধরা : বাঁশখালীর উপক‚লীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প ঘিরে কাজ চলাকালেই অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। ব্লক নির্মাণে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছিল ট্রাস্কফোর্স। সেসময় গণমাধ্যমে এই প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে বহু প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও সেগুলো আমলে নেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। এ প্রকল্পের ঠিকাদারদের সাথে যোগসাজশ করে সুবিধা নিয়ে খানখানাবাদের অনেকেই ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ হয়েছে। প্রকল্প তদারকির দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও পেয়েছেন পদোন্নতি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খানখানাবাদের বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘সাঙ্গু নদীর মোহনাটি নতুন নয়। আগামী ২০ বছরে মোহনার অবস্থান কোথায় যেতে পারে সেটি প্রকৌশলীদের বোঝা উচিত ছিল। এখন লুটপাট শেষ করার পর ডিজাইনের কারণে বাঁধের এমন পরিণতি হয়েছে বলাটা কাম্য নয়। প্রকৃতপক্ষে প্রকল্পটির অনিয়ম দুর্নীতি তদন্ত করা উচিত। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের ভুলের খেসারত দিচ্ছে খানখানাবাদবাসী। তারা এর দায় এড়াতে পারে না।’