ডা. সোমা চৌধুরী
আমার মা দীপালী ভট্টাচার্য। অনেক গুণে গুণান্বিত এক নারী। একাধারে শিক্ষক, লেখক, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, সুগৃহিণী, ভালো রাঁধুনী, স্নেহময়ী মা। ছোটবেলায় মায়ের হাতে সেলাই করা জামা পরতাম, শীতে তাঁর বোনা সোয়েটার পরতাম। সিজনাল অনেক রকম অপূর্ব স্বাদের আচার, মোরব্বা বানাতো মা। সাজলে মাকে নায়িকা লাগতো, ব্লাউজের কি সুন্দর ডিজাইন। প্রাণচঞ্চল, হাসিখুশি, আড্ডাপ্রিয়, আসর জমানো গল্পের ডিপো ছিল মা। আমার শৈশবে দেখেছি আমাদের বাসায় বেতার, বিভিন্ন সংঘ, শিক্ষক, শিল্পী কত গুণী লোকজন আসতো। দীর্ঘসময় লেখাপড়া, সাহিত্য, সংগীত, খেলা আর গল্প চলতো। শিল্পসমৃদ্ধ ঘর আমাদের। মা যেন দেবী দুর্গা। সব একা হাতে সামলাতো। মঞ্চে দাঁড়িয়ে কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতো। আমাকে বাংলা নোট করে দিতো (মা ছিল বাংলায় মাস্টার্স করা)। বলার সাথে সাথে যে কোন টপিক এক মুহূর্তে লিখে রেডি। মায়ের উৎসাহে তাঁর হাত ধরে আবৃত্তি, রচনা, উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম আমি। মা ছিল ভীষণ পরিশ্রমী। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে মায়ের বিয়ে হয়েছে। তারপর সংসার, শ্বশুর বাড়ি, বাচ্চা -সব সামলে এমএ বিএড করলো প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। পড়ার এত আগ্রহ। লেখালেখি-মায়ের ঈশ্বর প্রদত্ত গুণ। সাহিত্যের সব শাখায় তাঁর বিচরণ ছিল। আমাদের সারা ঘরে মা’র অজস্র লেখা। বসে থাকতো না। এটা ওটা করেই যেত। হাঁটুর ব্যথা বাড়তে বাড়তে মা গত প্রায় এক বছর বিছানায় শুয়ে থাকতো। হাঁটতে পারতো না। চিকিৎসা করানোর মন একদম ছিল না। জানি না বাঁচার জন্য কোনও আকুলতা কেন ছিল না।
এখন বাবার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না। মাছের তেল ভাজা, বড়ার তরকারি, ডাল শুকতো, মাছের ঝোল কত কি মা রাঁধতো। আর কখনো মাকে দেখবো না। মানতে কষ্ট হয়। তবুও প্রকৃতির নিয়ম মানতে হবে। মা আমি এখনো তোমার পাশে বসে সব কথা বলতে চাই। ভুল যদি করি মাগো ক্ষমা করে দিও। যেখানে গেছো সেখানে শান্তিতে থাকো মা। আমার জন্য আশীর্বাদ করো।
সাহিত্যিক দীপালী ভট্টাচার্য ১৮ এপ্রিল বিকেলে নগরীর একটি হাসপাতালে ৭৫ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। চট্টগ্রাম একাডেমির প্রতিষ্ঠাতাকালীন পরিচালক দীপালী ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৮ অক্টোবর রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়ায়। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘স্বপ্নসুখ ভালবাসা’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে। সেই থেকে এ পর্যন্ত অনেকগুলো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। তন্মধ্যে রয়েছে- রাজকন্যা, গল্পে গল্পে উপদেশ, ছড়াসমগ্র, ছোটদের গল্পসমগ্র, কবিতাসমগ্র, শিয়াল মামার বিয়ে, ইচ্ছেপরী ও তুতুন, যাপিত জীবনের রম্যগল্প প্রভৃতি।
লেখক: গাইনোকোলজিস্ট