নিজস্ব প্রতিবেদক
ভুয়া অংশীদারি চুক্তিপত্র, ব্যাংক একাউন্ট ও জাল কাগজপত্র সৃজন করে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২৪ কোটি ৭১ লক্ষ টাকা আত্মসাতের দায়ে ব্যাংক কর্মকর্তাসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১ এর উপ-সহকারী পরিচালক সবুজ হোসেন বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলার আসামিরা একে অপরের যোগসাজশে আবদুস সবুর চৌধুরী নামে এক ব্যক্তির নাম ও কাগজপত্র ব্যবহার করে মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক সিডিএ এভিনিউ শাখা হতে ২০০৭ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১০টি হিসাবের মাধ্যমে এ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। যা দুদক প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মামলায় আসামিরা হলেন, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড নাসিরাবাদ সিডিএ এভিনিউ শাখার সাবেক এভিপি ও ব্যবস্থাপক মো. তাজুল ইসলাম চৌধুরী (৫৭), একই শাখার সাবেক এভিপি কাঞ্চন কুমার দে (৫৭), গ্রাহক সাতকানিয়া খাগরিয়া এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম চৌধুরী (৫১), ডবলমুরিং বাংলা বাজার স্ট্যান্ড রোডের দোভাষ ভবনের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন দোভাষ (৬৯)।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে দুদকের উপ-পরিচালক নাজমুচ্ছায়াদাত পূর্বদেশকে বলেন, প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদনের পর মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। তদন্তকালে অন্য কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তা আইন অনুযায়ী আমলে নেয়া হবে। দুদক মামলাটি তদন্ত করবে।
মামলা সূত্রে জানা যায়, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও কাঞ্চন কুমার দে ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনকালে মেসার্স এইচ এন্ড কর্পোরেশন নামে একটি চলতি হিসাব (নং ৩৩০০০৯৭৬) খুলেন। অপর দুই আসামি মো. সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ও ইকবাল হোসেন দোভাষ এর ছেলে মো. জাহিদ দোভাষকে উক্ত চলতি হিসাবের নমিনী দেয়া হয়। ব্যাংক কর্মকর্তা আসামি মো. তাজুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন সেই হিসাবের ইন্ট্রোডিউচার। মো. আবদুস সবুর চৌধুরী ও আসামি ইকবাল হোসেন দোভাষকে একাউন্ট ওপেনিং ফরমে মেসার্স এইচ এন্ড কর্পোরেশন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রোপাইটর উল্লেখ করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ৮২, আসাদগঞ্জ, কোতোয়ালী চট্টগ্রাম উল্লেখ করা হলেও উক্ত ঠিকানায় প্রতিষ্ঠানের কোন অস্তিত্ব ছিল না।
২০০৮ সালে একই প্রতিষ্ঠানের নামে একটি সিসি (হাইপো) ঋণ (হিসাব নং-২৭০০০০১৬৯) খোলা হয়। ২০০৮ সালের ১জুলাই মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে পার্টনারশিপ দলিল সৃজন করা হয় এবং একই তারিখে অংশীদারি চুক্তিপত্র কার্যকারিতা লাভ করবে মর্মে উল্লেখ করা হয়। মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে অংশীদারি চুক্তিপত্র ২০০৮ সালের ৩জুন তারিখে সৃজন হলেও উক্ত প্রতিষ্ঠানের নামে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড, সিডিএ শাখা, চট্টগ্রাম এ ২০০৭ সালের ১৭এপ্রিল চলতি হিসাব (নং-৩৩০০০৯৭৬) খোলা হয়েছে। অংশীদারি চুক্তিপত্রে পার্টনারদ্বয়ের যৌথ স্বাক্ষরে ব্যাংক হিসাব পরিচালনার কথা উল্লেখ থাকলেও হিসাব নং-৩৩০০০৯৭৬ এর একাউন্ট ওপেনিং ফরমে অংশীদারদের যে কোন একজন হিসাব পরিচালনা করবেন মর্মে উল্লেখ রয়েছে। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে আসামীগণ সহযোগিতা ও পরস্পর যোগসাজশে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিঃ, সিডিএ শাখা, চট্টগ্রাম এ ‘মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন’ নামে ভুয়া ও মিথ্যা একাউন্ট সৃজন করেন। ‘মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন’ নামে পার্টনারশিপ দলিল সৃজন করার পূর্বেই ‘মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন’ নামে ব্যাংকে হিসাব খোলা হয়েছে এবং হিসাব নং-৩৩০০০৯৭৬ এ লেনদেন করেছেন যা প্রতারণা এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আসামী ইকবাল হোসেন দোভাষ মেসার্স এইচ এন্ড কর্পোরেশন অনুকূলে ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে তার মালিকানাধীন ভূমিসহ চার তলা বিশিষ্ট ভবন বন্ধক রাখেন। ২০০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রথম বার স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিঃ, সিডিএ শাখা ‘মেসার্স এইচ এইচ কর্পোরেশন’ বরাবর ৮ কোটি টাকা কম্পোজিট ঋণের সুবিধা প্রদান করলেও প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে একাধিকবার ঋণের লিমিট নবায়ন করে। সর্বশেষ ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড, প্রধান কার্যালয় ১৮.৫০ কোটি টাকায় ঋণের সুবিধা মঞ্জুর করে। এভাবে আসামী তাজুল ইসলাম চেীধুরী, কাঞ্চন কুমার দে ও সাইফুল ইসলাম চৌধুরী প্রতারণা করে মো. আবদুস সবুর চৌধুরীর নাম ব্যবহার করে ভুয়া কাগজপত্র সৃজনপূর্বক তা ব্যবহার করে কৌশলে ঋণের লিমিট বৃদ্ধি করে এবং লোকাল ও ফরেন এল/সি খোলে এবং পরবর্তীতে এলসি সমূহকে এলটিআর ও পিএডি তে রুপান্তর দেখিয়ে ঋণের টাকা ডিসভার্সড করে ব্যাংকের মোট ২৪ কোটি ৭১ লক্ষ ৪২ হাজার ৪০৬টাকা আত্মসাত করেছেন। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড প্রধান কার্যালয় কর্তৃক ব্যাংক কর্মকর্তা আসামী তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও আসামী কাঞ্চন কুমার দে এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ বিষয়ে তদন্ত করে ২০১৩ সালের ৯জুন তাদেরকে চাকরি থেকে অপসারণ করে।
আসামীগণ প্রতারণা করে ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ২০০৮ সালের ২৮ মে তারিখে বন্ধকী সম্পত্তির মূল্য ৪২৪.৪২ লাখ দেখালেও সে একই সম্পত্তির ২০১০ সালের ১৯ আগস্ট তারিখে ৭.১০ কোটি টাকা মূল্য দেখানো হয়। এছাড়াও আসামীগণ প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাথের উদ্দেশ্যে ২০০৮ সালের ৭জুলাই তারিখে গোডাউনে স্টক পণ্য প্রাথমিক সিকিউরিটি বাবদ মূল্য উল্লেখ করেন ১০.০৬ কোটি টাকা এবং ২০১০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তারিখে সিকিউরিটি বাবদ স্টক পণ্যের ২৪.৮ কোটি টাকা মূল্য দেখানো হয়। এভাবে আসামীগণ প্রতারণা করে মিথ্যা জাল ডকুমেন্টস সৃজন করে জামানতের মূল্য বৃদ্ধি করে প্রধান কার্যালয়ে ঋণের লিমিট বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাব করে এবং ঋণ ডিসভার্সড করে ব্যাংকের ২৪ কোটি ৭১লাখ ৪২হাজার ৪০৬টাকা আত্মসাত করেন। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড, সিডিএ এভিনিউ শাখা ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর তারিখে ১৮.৫০ কোটি টাকার কম্পোজিট ঋণ সুবিধা প্রদান করলেও রেকর্ডপত্রের আলোকে ২০১১ সালের ৮মার্চ তারিখ পর্যন্ত সিডিএ এভিনিউ শাখা মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে তিনটি লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট (এলটিআর) হিসাব যথাক্রমে ০২৩৮৬৮০০১০১, ০২৩৮৬৮০০১০২, ০২৩৮৬৮০০১০৩; ৬ টি পেইড এগেইনস্ট ডকুমেন্টস (পিএডি)হিসাব যথাক্রমে ০২৩৮৭৩০২৪৯৫, ০২৩৭৩০২৫২০, ০২৩৮৭৩০২৫২২, ০২৩৮৭৩০২৫২৩, ০২৩৮৭৩০২৫৪২, ০২৩৮৭৩০২৫৪৫ ও একটি ক্যাশ ক্রেডিট (সিসি) (হাইপো) হিসাব নং ১৫০০০১৬৯ মোট ১০টি হিসাবের মাধ্যমে আসামীগণ ধারাবাহিকভাবে এলসি খোলার নামে বিভিন্ন কাগজপত্র সৃজন করে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিঃ, সিডিএ এভিনিউ শাখা, চট্টগ্রাম থেকে ঋণের সুবিধা গ্রহণ করে সময়মত পরিশোধ না করে উক্ত ২৪ কোটি ৭১লাখ ৪২ হাজার ৪০৬টাকা আত্মসাত করেছেন। আসামী সাইফুল ইসলাম চৌধুরী মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকের সমস্ত দায় দেনার ব্যক্তিগত জামিনদার ও গ্রান্টার ছিলেন। তিনি ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর তারিখে ব্যাংকের লেটার অব গ্রান্টিতে জামিনদার হয়ে স্বাক্ষর প্রদান করেন। মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে বাস্তবে কোন প্রতিষ্ঠান না থাকার স্বত্বেও আসামীগণ মেসার্স এইচ এন্ড এইচ কর্পোরেশন নামে ভুয়া একাউন্ট সৃজন করে এবং আসামী ইকবাল হোসেন দোভাষ এর সম্পত্তিকে ব্যবহার করে ভ্যালুয়েশন প্রতিবেদনে বার বার মূল্য বৃদ্ধি করে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিঃ, সিডিএ শাখা, চট্টগ্রাম হতে ২৪ কোটি ৭১লাখ ৪২ হাজার ৪০৬ টাকা ঋণগ্রহণপূর্বক আত্মসাত করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।