ভীতিকর এক রোগের নাম স্ট্রোক

1

লিটন দাশ গুপ্ত

একসময় অনেক মানুষ ছিল, যারা নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে কিংবা রোগশোক নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা করতো না, কোন প্রকার সচেতন ছিলনা। সেইসময় অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্য সচেতন পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, শৈশবে আমার মা থেকে যে দুটি রোগের ভয়াবহতার কথা শুনে এসেছি তার মধ্যে একটি হচ্ছে স্ট্রোক, অন্যটি ক্যান্সার। স্ট্রোক এমন একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা, যা থেকে যে কোন সময় ঘটতে পারে বড় ধরণে দূর্ঘটনা। এই দেখলাম সুস্থ সবল জীবন্ত মানুষ, কিছুক্ষণ পর শুনলাম মরে গেল! প্রায় বছর দুয়েক আগের কথা, আমার প্রতিষ্ঠানে এসেছিলেন সেই সময়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব কে এম নুরুল হুদা সাহেব। তিনি যখন এসেছিলেন তখন বিকাল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। সাথে এসেছিলেন নির্বাচন কমিশন সচিব, জেলা প্রশাসক, পুলিশ কমিশনারসহ আরো অনেক জেলা-উপজেলা কর্মকর্তা। নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল পুলিশ বিডিআর; পরিবেশ ছিল নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল। প্রায় দেড় থেকে দুই ঘন্টা পশ্চিম গোমদন্ডী বশরত নগর সরকারি জুনিয়র হাইস্কুলে অবস্থান করেছিলেন তিনি। তিনি বেশ আন্তরিক ও মিশুক প্রকৃতির হওয়ায় এই সময় অনেক কথা হয়, সাথে অনেক ছবি উঠানো হয়। উপস্থিতি অন্যান্যদের মধ্যে স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা শামসুল আলম ছিলেন। তিনি ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন সভাপতি এবং আমি প্রধানশিক্ষক হওয়ার সুবাদে তাঁর সাথে মোটামুটি সুসম্পর্ক ছিল।
সেদিন তিনিও উপস্থিত থাকায় বেশ কিছু ছবিতে উঠেছিলেন। সন্ধ্যার পর হওয়ায় এবং আমি ব্যস্ত থাকার কারণে তিনি ছবিগুলো সেদিন নিয়ে যেতে পারেননি। তবে যাবার সময় দুষ্টুমির ছলে বলে গেছেন, যা এখনো কানে প্রতিধ্বনি হয়, ‘স্যার আপনি দেখছি ব্যস্ত আছেন, আমার ছবিগুলো ডিলিট করবেন না প্লিজ, কালকে সকাল সকালে এসে নিয়ে যাব। আর চাইলে ডিলিট করতে পারেন, তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে আবার এনে আমাকে নিয়ে ছবি উঠায়ে দিতে হবে।’ এই বলে, হেসে হ্যান্ডশেক করে চলে গেলেন। পরদিন সকালে যথাসময়ে এসে অবাক হয়ে গেলাম! তিনি আর নাকি কোনদিন ছবিগুলো নিতে আসবেন না! কারণ তিনি সেই রাতেই স্ট্রোক করে মারা গেছেন। এটি সর্বশেষ একটা ঘটনার কথা বললাম, স্ট্রোকের কারণে এই রকম আরো অনেক আকস্মিক বিস্ময়কর মৃত্যুর ঘটনা দেখেছি ও শুনেছি।
স্ট্রোক হচ্ছে এমন একটি রোগ, যার কারণে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহে ঘটায়। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতি ৬ সেকেন্ডে একজন করে স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং এইভাবে মৃত্যুবরণ করছেন। সেই হিসাবে প্রতি বছরে আক্রান্ত হচ্ছে ৬ কোটি এবং তার মধ্যে মারা যাচ্ছে এক তৃতীয়াংশ বা ২ কোটি মানুষ। শুধু মারা যাচ্ছে তা নয়, এই স্ট্রোকের কারণে অনেক লোক পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। যারা পঙ্গু হচ্ছে তারা বেঁচেও অর্ধেক মৃত অবস্থায় দিনযাপন করছে। এছাড়া প্রতি ৬ জনের মধ্যে ১ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা রয়েছে। অন্য একটি হিসাবে জানা যায়, স্ট্রোকে আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ ভাগ মারা যায়, আর ৩০ ভাগ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন, অবশিষ্ট ৩০ ভাগ নিয়মিত ঔষধ সেবন করে তুলনামূলকভাবে কোন রকমে বেঁচে থাকে। তারা বেঁচে থেকেও দুর্বিষহ জীবনযাপন করে। আমাদের দেশে এখন ১৫ থেকে ২০ লাখ স্ট্রোকের রোগী রয়েছে। সাড়া বিশ্বে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার দিন দিন বেড়েই চলছে। অনেক ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবেই এই রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। স্ট্রোক সম্পর্কিত কিছুটা তথ্যজ্ঞান থাকলে ও সচেতন হলে মৃত্যু ও আক্রান্তের হার কমিয়ে আনা যায়। তাই স্ট্রোক সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৯ অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে।
অনেক চিকিৎসকের কথায়, স্ট্রোক একটি জিন গঠিত ঘটনা। সাধারণত বংশানুক্রমে অনেকের স্ট্রোক হয়ে থাকে। তাই যাদের পারিবারিক ভাবে স্ট্রোক এবং হৃদরোগের ইতিহাস রয়েছে তাদের ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়াও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির কারণ রয়েছে যা চেষ্টা করলে ও একটু সচেতন হলে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেমন- নিয়মিত কোলেস্টরল মাত্রা পরীক্ষা এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা। এছাড়া ধুমপান স্ট্রোকের অন্যতম কারণ। তাই তামাকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। নির্দিষ্ট উচ্চতা অনুযায়ী নিজের নির্দিষ্ট ওজন বজায় রাখাও দরকার। বর্তমানে অনেক মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। অবশ্য তাদের মধ্যে আমিও একজন। তবে অনেকেই ডায়াবেটিস থাকলেও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে উদাসিন। তাই তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকিটা তুলনামূলক বেশি থাকে। এই অবস্থায় কারো মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি আছে কিনা, থাকলে এর কারণগুলি কি এবং এর মোকাবেলায় কি করতে হবে তা জানার জন্য, বছরে অন্ততঃ একবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত।
স্ট্রোকের আগে এমন সাধারণ কিছু লক্ষণ রয়েছে, যা প্রকাশ পাবার সাথে সাথে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া খুবই দরকার। যেমন- মুখ, হাত বা পায়ের আকস্মিক অসাড়তা বা দুর্বলতা অনুভব। এই রকম কিছু হলে ক্ষণ বিলম্ব না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া হঠাৎ মনে কোন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া, কথা বলতে বা বুঝতে হঠাৎ সমস্যা হওয়া, হঠাৎ চোখে ঝাপসা দেখা ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পেলে নিকটস্থ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। এছাড়া হঠাৎ হাঁটতে সমস্যা হলে, ভারসাম্য বা সমন্বয় হারিয়ে ফেললে অথবা কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ তীব্র মাথাব্যথা দেখা দিলে অবহেলা না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার। এভাবে কিছুটা সচেতন হলে স্ট্রোক অনেকাংশে কমিয়ে আনা যাবে। যাইহোক আমি কোন ডাক্তার বা চিকিৎসক নয়, একজন স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ যা জানা প্রয়োজন, তা জেনেই জানানোর চেষ্টা করেছি। এই জন্যে আমি আমার প্রয়াত মায়ের কাছে সশ্রদ্ধ ঋণী। এখন কথা হচ্ছে নিজেকে ও পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষিত রাখতে নিজে সচেতন হোন, অন্যকে সচেতন করুন।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট