ভাষা আন্দোলনের চেতনার মর্মার্থ ও যথার্থতা

1

ডা. আর. কে রুবেল

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি সোপান হিসেবে রক্তের অক্ষরে লেখা ইতিহাসের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনাকাল। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তি এবং দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যূদয় এই উপমহাদেশে বিভাজনের যে সীমারেখা তৈরি করে দিয়েছে তা অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক হিসেবে চিহ্নিত হয় পরবর্তীকালের ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে। আমরা জানি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাঙালি মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল। তৎকালিন পূর্ব বাংলার প্রায় সকল মুসলিম বাঙালি পাকিস্তান প্রস্তাবের পক্ষে রায় ঘোষণা করেছিল এ কারণেই যে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হলে বাঙালি মুসলিম সমাজ শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাবে। কেননা তৎকালিন পূর্ব বাংলায় অনগ্রসর মুসলিম সমাজ কুলিন অমুসলিম জমিদারদের দ্বারা নানাভাবে নিগৃহিত হচ্ছিল এবং প্রজা হিসেবে তাদের অবস্থান ছিল দলিত অংশীজন হিসেবে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই, এই রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির পিতা হিসেবে ধরে নেয়া হয় জিন্নাহকে- তিনি ১৯৪৮ সালে যখন ঢাকায় ঘোষণা করেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই একটি মাত্র ঘোষণার মধ্য দিয়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালি মুসলমানরা কখনো স্বাধীন বা তাদের অধিকার রক্ষায় এই মাটি তাদের সহায়ক হবে- সে সম্পর্কে তাদের মোহভঙ্গ ঘটে।
পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ ছিল বাঙালি এবং উর্দুভাষীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪ শতাংশ। এতে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানে বাঙালিরা জাতিগত নিপীড়ন ও শোষণের শিকার হতে চলেছে। তারই প্রাথমিক সূত্র হিসেবে প্রথমই বাঙালি ভাষার উপর আঘাত হানা হয়েছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি হিসেবে বাঙালিদের অধিকার চিরতরে ভুলূণ্ঠিত করার নীলনকশা বাস্তবায়ন সূচিত হয়েছিল। তাই পাকিস্তানের বাংলাভাষী বাঙালি জাতিগোষ্ঠী ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই ১৯৪৮ সাল থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রæয়ারি ভাষার জন্য বাঙালি রক্ত দিয়ে প্রমাণ করে যে, ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তার অভ্যূদয় অবশ্যম্ভাবী।
স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালির একটি ভৌগলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হলেও অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে মীমাংসিত হয়নি। আমরা যে ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার তা কতটুকু নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পেরেছি সে প্রশ্ন এসে যায়। বাংলাদেশে নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলেও অর্থনৈতিক মুক্তি তথা মানুষের সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও অর্জনের ক্ষেত্রটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। কেননা স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যমুক্ত স্বাধীন জনসমাজ। এই লক্ষ্যটি পূরণে রাজনৈতিক ও আর্থ সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান অতীতেও ছিল এখনো আছে। তাই অর্থনৈতিক মুক্তি ব্যতীত একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা শতভাগ পরিপূর্ণ হয়নি তা সহজেই অনুমেয়।
আমাদেরকে এই উপলব্ধি থেকেই মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনায় অর্থনৈতিক মুক্তির কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণের মধ্য দিয়েই অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থপূর্ণ করতে হবে। যদি ব্যর্থ হয় তাহলে একুশের চেতনা একটি আনুষ্ঠানিকতার গন্ডিতে আবদ্ধ থেকে যাবে। এ থেকে অবশ্যই মুক্তি পেতে হবে। এছাড়া আমরা যদি মনে করি ভাষা আন্দোলন শুধুমাত্র ভাষার অধিকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে আমরা একটি মরীচিকার মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে চলেছি। এদেশের একটি শ্রেণি মোট রাষ্ট্রীয় সম্পদের ৮০ শতাংশেরও বেশি সম্পদের ভোক্তা হলেও ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ কোন না কোনভাবেই শোষিত ও বঞ্চিত হচ্ছে। এই শোষণ ও বঞ্চনা থেকে পরিত্রাণ পেলেই একুশের চেতনা ও মর্মার্থ যথার্থ প্রমাণিত হবে।
লেখক: সাংস্কৃতিক সংগঠক, সমাজসেবী ও চিকিৎসক