ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কি আসন্ন ?

1

আকতার কামাল চৌধুরী

কার্গিল যুদ্ধের ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল। এ যুদ্ধ শুরু করেছিলেন সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফ, প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই। চেইন-অব-কমান্ডের মারাত্মক ব্যত্যয় জেনেও নেওয়াজ শরীফ দাঁতে দাঁত চেপে চুপ থাকেন রাষ্ট্রের স্বার্থে। তাৎপর্যপূর্ণ হলো,সরকার প্রধানের প্রতি সেনাপ্রধানের এমন উদ্যত্তপূর্ণ আচরণের খবর ফাঁস হলে পাকিস্তানের জন্য খবর আছে বৈকি। বিশেষকরে সৈন্যরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে আর যুদ্ধ যখন চিরশত্রুর সাথে।
সে যাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের সালিসিতে কোনোভাবে দফারফা হয়। এরপর পারভেজ মোশাররফ নেওয়াজ শরীফকে হটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেন। পরবর্তীতে নাইন ইলেভেনের ঘটনায় কথিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে ‘জান কোরবান করা’ পারভেজ মোশাররফ পশ্চিমাদের দাসত্ব করে তাদের বাধ্যগত অনুচরে পরিনত হন। সাথে তাঁর অবৈধ ক্ষমতাগ্রহণকেও বৈধতা দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যান।
এবারের প্রেক্ষাপট কিন্তু একদম অন্যরকম। পাকিস্তানে এখন চলছে সরকার-সেনাবাহিনীর মধুচন্দ্রিমা। বর্তমান শাহবাজ শরিফের সরকার পুরোপুরি সেনাসমর্থিত সরকার।আরও খোলাসা করে বললে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সরকারও। এমন দৃশ্য পাকিস্তানে বিরল।
ইমরান খানের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্র একাট্টা। আর এতেই কপাল খোলে দেশের এবং নির্বাসিত রাজনীতিবিদদের। ঠিক এ সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেনও তাঁরা।
ইমরান খানের অপরাধ কী ছিল? ইমরান খানের মোটাদাগে অপরাধ ছিল, তিনি পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আনতে তথা যুক্তরাষ্ট্রের নাচের পুতুল না করার চেষ্টা করেছিলেন। আর যায় কোথায় – রেগে অগ্নিশর্মা যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে করতলে নিয়ে ফেলে। তাই সংগতকারণেই এই ত্রি-চক্রের সম্মিলিত শক্তি আর ষড়যন্ত্রের সামনে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি ইমরান খানের পক্ষে। প্রথমে অনাস্থা ভোটে তাঁর সরকারকে ফেলে দেওয়া হয়। তারপর নির্বাচনের ফলাফল আর জনপ্রিয়তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে কথিত মামলায় ইমরান খানকে জেলে আটকে রাখা হয়। অবশ্য, পাকিস্তানের এটাই চিরায়ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনার পারদ আবার চরমে। গত ২২ই এপ্রিল কাশ্মীরের প্যাহেলগামে বন্দুকধারীদের গুলিতে ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এ উত্তেজনা। বরাবরের মতোই ভারত এ হত্যাকান্ডের জন্য পাকিস্তানকেই দায়ী করে। অভিযোগ করে,তাদের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী গ্রপ-ই এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। এ ঘটনায় সৌদি আরব সফরে থাকা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সফরসূচি কাটছাঁট করে তড়িঘড়ি দেশে ফিরে আসেন।
এ ঘটনার জের ধরে ভারত-পাকিস্তান পাল্টাপাল্টি কিছু সিদ্ধান্তও নেয়।
ওইদিন থেকে সীমান্তে গোলাগুলি থেমে নেই। এ গোলাগুলি সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নেয় কি না সেটাই এখন আশঙ্কা। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উভয় দেশের সামরিক শক্তির তুলনামূলক পরিসংখ্যানও প্রকাশ করে যাচ্ছে। এরমধ্যে পারমাণবিক শক্তিও অন্তর্ভুক্ত।
নিউইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি খবর দিচ্ছে,ভারত পাকিস্তানে সামরিক আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারত ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে তুলছে। এমনকি আরও যুদ্ধবিমান কেনার প্রস্তুতিও গ্রহণ করেছে।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ভারতের আক্রমণ আসন্ন ধরে নিয়েই সামরিক বাহিনী প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তিনি আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন,’তাদের পারমাণবিক বোমাগুলো এমনি এমনি বানানো হয়নি, সবগুলো ভারতের দিকে তাক করা আছে’।
তাৎপর্যপূর্ণ হলো, কাশ্মীরের এবারের ঘটনায় পাকিস্তানকে সরাসরি দায়ী করে চিৎকার দিয়ে ওঠেনি যুক্তরাষ্ট্র। যা তারা সচরাচর করে থাকে। দেখা যায়,এ ঘটনার অব্যবহিত পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নরেন্দ্র মোদীকে ফোন করে পাশে থাকার কথা শোনান। পরে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তান নিজেরাই নিজেদের বিষয়গুলো মিটিয়ে ফেলবে’। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র একটি গতানুগতিক ও দায়সারা গোছের বক্তব্য দেয়।
এর কারণ হতে পারে পাকিস্তানের বর্তমান সরকার। চাউর আছে,সংসদে অনাস্থা ভোটে ইমরান খানকে কৌশলে উৎখাত করে সেনাসমর্থনে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্র। তাই হয়তো যুক্তরাষ্ট্র চায় না এ সরকার কোনো ইস্যুতে বেকায়দায় পড়ুক।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের অবস্থান খুবই সংহত। যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার মধ্যে যতই বিরোধ থাকুক, উভয় রাষ্ট্রের কাছে ভারত গুরুত্বপূর্ণ। উদীয়মান এ শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া কেউ-ই হাতছাড়া করতে নারাজ। বিশেষকরে চীনকে দমিয়ে রাখতে ভারতকে কাছে টানা চাই যুক্তরাষ্ট্রের।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আবার পাকিস্তানকেও বেজার করতে রাজি নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশি গুরুত্বপূর্ণ না হলেও পাকিস্তানকে নিজের বলয়ের বাইরে রেখে চীন-রাশিয়া-ইরানের বলয়ে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি নয় তারা। যুক্তরাষ্ট্র বোঝে,সামরিক অস্ত্রসস্ত্রের জন্য পাকিস্তান চীন-রাশিয়ার দিকে ঝুঁকলেও মোটাদাগে তাদের বৃত্তের বাইরে পা দেয় না।
রাশিয়ার চোখেও পাকিস্তান-ভারত উভয় রাষ্ট্র তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাই রাশিয়াও চায় না দুদেশে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠুক। চীনের অবস্থান তো এমনিতেই ভারতের বিরুদ্ধে। ও-দিকে ইরান এ ক্রমবর্ধমান সংকট নিরসনে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে।
এই যখন দুই দেশ নিয়ে শক্তিধর দেশগুলোর অবস্থান, এমুহূর্তে ভারত যদি পাকিস্তান আক্রমণ করেই বসে সেটা একপাক্ষিক এবং অদূরদর্শী হতে পারে। ভারতের কোনো বন্ধুরাষ্ট্র এ হামলাকে অন্ধ সমর্থন দিবে আপাতদৃষ্টিতে তা ভাবার সময় আসেনি। বরং ভারত-ই তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিযুক্তের খাতায় নাম লিখিয়ে পাকিস্তানকে সুবিধা করে দিতে পারে। মনে হয় ভারতও বিষয়টা বোঝে। আর তাই, ভারত-পাকিস্তানের চলমান উত্তেজনার সর্বশেষ পরিণতি যুদ্ধ- এটা ভাবার অবকাশ আপাতত নেই হয়তো।
লেখক : প্রাবন্ধিক