জসিম উদ্দিন মনছুরি
২২ এপ্রিল ২০২৫ জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। এ ঘটনার জেরে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে প্রতিবেশী দুইটি রাষ্ট্রই। পেহেলগামে ২৬ পর্যটককের হত্যাকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানকে দোষারোপ করে আসছে। পক্ষান্তরে পাকিস্তান নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে আসছে। তারা পর্যটক হত্যার আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছে। ভারত পাকিস্তান বৈরী সম্পর্কের দুইটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র । ভারতের অভ্যন্তরে যে কোন ঘটনার দায় ভারত বরাবরই পাকিস্তানের উপর ছাপিয়ে দেয়।১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ থেকে ভারত, পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হলেও দুই দেশের মধ্যে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে কয়েকবার যুদ্ধ হয় । কাশ্মীরকে দুই দেশই তাদের ভূখন্ড বলে দাবি করে । বর্তমানে কাশ্মীর পাকিস্তান , ভারত ও চীন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৪৭ সালে, ১৯৬৫ সালে ও ১৯৯৯ সালে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারত প্রতিনিয়ত কাশ্মীরের নিরীহ মুসলিমদের নির্যাতন ও নিপীড়ন করে আসছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য কাশ্মীরে প্রায় ৬৫% মুসলমানের বসবাস। মুসলমান অধ্যুষিত এ রাজ্যকে পৃথিবীর ভূস্বর্গ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও নান্দনিক সৌন্দর্যময় এ অঞ্চলটি। সাম্প্রতিক ২২ এপ্রিল ২০২৫, ২৬ জন পর্যটকের হত্যাকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে আসছে। কিন্তু পাকিস্তান এই দাবি অস্বীকার করে নিরপেক্ষ স্বাধীন তদন্ত দাবি করেছে। পাকিস্তানকে শায়েস্তা করার জন্য ভারত যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। পাকিস্তানও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বলে ভারতকে জানিয়ে দিয়েছে। তবে তারা আগে আক্রমণ করবে না কিন্তু ভারতের কাছ থেকে আক্রমণের শিকার হলে পিছু হটবে না বলে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে। পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনার জেরে ভারত সিন্ধু নদীর পানি বন্ধ করে দিলে পাকিস্তান ভারতীয় বিমানের জন্য তার আকাশসীমা বন্ধ করে দেন। ভারতের পানি বন্ধ করাকে পাকিস্তান যুদ্ধের ঘোষণা বলে ধরে নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের দুইটি গোয়েন্দা ড্রোন ভূপাতিত করে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দেন। উত্তেজনার মধ্যে ভারতের বিমান বাহিনী চারটি রেফল বিমান নিয়ে পাকিস্তান সীমান্তে গেলে পাকিস্তানের বিমান বাহিনী সাথে সাথে তাদেরকে ধাওয়া দিলে তারা ভয়ে পালিয়ে যায়। কথিত আছে ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা খুবই দুর্বল। চল্লিশ বছর আগের রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান গুলোই তাদের ভরসা। জরাজীর্ণ বিমান গুলি অতি পুরনো হওয়ায় মধ্য আকাশে বিকল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষায় শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ৩৬টি রেফল বিমানই ভরসা। এরই মধ্যেই পাকিস্তান করাচির অদূরে ভারতীয় জলসীমানার কাছাকাছি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে। এবং তারা অস্ত্রের মহড়াও দিয়েছে। তা থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত ভারত যেন যুদ্ধে জড়াবার আগেই পাকিস্তানের শক্তিশালী অবস্থান দেখেই জড়ান। পক্ষান্তরে পাকিস্তানের রয়েছে আমেরিকার তৈরি এফ সিক্সটিন বিমান সহ চীনের তৈরি বেশ কিছু অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান। ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া বিশেষ করে পাকিস্তানিদের উপর দোষ চাপানো পুরাতন অভ্যাস। ঘটনার সাথে সাথেই কাল বিলম্ব না করে পেহেলগামের হত্যাকান্ডকে পাকিস্তানের সংগঠিত বলে দ্রুত চালিয়ে দেয়। তবে পাকিস্তান এ অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। এবং তারা এর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছে। ভারত কোন কিছুর তওয়াক্কা না করে যুদ্ধে জড়াবার জন্য অস্থির হয়ে গেছে। পাকিস্তানও শক্তিশালী সেনা বহর ও যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যে কোন আগ্রাসী আক্রমণকে রুখে দেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর রয়েছে। উত্তেজনার মধ্যে ভারত পাকিস্তানি নাগরিকদের পাকিস্তানে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পাকিস্তানও ভারতীয় নাগরিকদের ভারতে ফিরে যাওয়ার জন্য সময় বেঁধে দিয়েছে। এরই মাঝে ভারত তালেবানদের সাথে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছে। ভারত আফগানিস্তানকে নিজেদের সাথে যুক্ত করে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চীন পাকিস্তানের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। চরম উত্তেজানার মধ্যেই সৌদি আরব ও ইরান ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা শক্তিশালী করতে আইএসআই প্রধান মালিককে জাতীয় নিরাপত্তা প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছেন। এর আগেও বৈরী প্রতিবেশী দুইটি রাষ্ট্র বেশ কয়েকবার যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হলেও পরবর্তীতে অদৃশ্য কারণে ভারত পিছিয়ে এসেছে। সা¤প্রতিক সময়ে ভারতের আগ্রাসী নীতির কারণে প্রতিবেশী কোন রাষ্ট্রের সাথে তেমন একটা সুসম্পর্ক নেই। তারা হুংকার দিলেও তাদের আকাশ প্রতীরক্ষা সিস্টেম খুবই দুর্বল হওয়ায় সা¤প্রতিক সময়ে ফ্রান্স থেকে পঞ্চম প্রজন্মের চল্লিশটি যুদ্ধবিমান ক্রয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এত ব্যয়বহুল প্রজেক্টটি মোদি সরকার গ্রহণ করবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথেও বর্তমানে তেমন একটা সুসম্পর্ক নাই মোদি সরকারের। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের পানি বন্ধ করা যেন তাদের পুরনো রীতি। তিস্তা নদীতে বাদ দিয়ে বর্ষা মৌসুমে পানি ছেড়ে দেওয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া ফলে বাংলাদেশের সাথেও পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে রয়েছে বিস্তর সমস্যা। সীমারের উত্তরসূরী ভারত ইতিমধ্যেই সিন্ধু নদের পানি বন্ধ করে দিয়ে একতরফা নীতি অবলম্বন করেছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের শীর্ষে থাকা দেশটি ভারতীয় মুসলমানদের চরম ভাবে নির্যাতন নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। মুসলমানদের ধর্মীয় উপাসানালয় বাবরি মসজিদ থেকে শুরু করে অনেক পুরাতন মসজিদ ও স্থাপনা গুড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ভারতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু নির্যাতিত হয়। কথিত আছে পেহেলগামের পর্যটকদের মোদি সরকার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মেকানিজমের মাধ্যমে হত্যা করে পাকিস্তানের উপর ঘটনা ছাপিয়ে দিচ্ছে। যেন মোদির ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয়। পাকিস্তান বরাবরই সংযমের পরিচয় দিয়ে আসছে। তবে তারা যে কোন আগ্রাসী নীতি প্রতিহত করার জন্য বদ্ধপরিকর রয়েছে। পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দল ও জনগণ ভারতকে রুখে দাঁড়াবার জন্য একতাবদ্ধ হয়েছে। জেলের মধ্য থেকে পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা ইমরান খানও ভারতকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
ইতোমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২৯ এপ্রিল সেনাবাহিনীর সাথে বৈঠকে সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী নিশ্চিত করেছে ৩৬ ঘন্টার মধ্যে ভারত পাকিস্তানে আক্রমণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকেও সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। সীমান্তে দুই দেশই সেনাবাহিনীকে জড়ো করেছে। সেনাবাহিনীর মধ্যেই গুচ্ছ আকারে গোলা বিনিময়ের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়া ভারত পাকিস্তানের দ্ব›েদ্ব অস্থির হয়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করে পাকিস্তানকে পরাজিত করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ হলেও বিশ্লেষকদের ধারণা ভারত প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানকে শায়েস্তা করার জন্য বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করেছিলো। কথিত আছে ভারতের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রচুর ধনসম্পদ ও অর্থ ভারতে নিয়ে যায়। এই প্রতিবেশী দুইটি রাষ্ট্রের মধ্যেই দ্বন্দ্বের মূল কারণ হলো জম্মু কাশ্মীর। ১৯৪৭ সালে দুই দেশের স্বাধীনতা লাভ করলেও জম্মু-কাশ্মীরকে নিজেদের বলে দাবি করে আসছে দুই দেশই। ইতিমধ্যেই যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। এবার দেখার বিষয় ভারত সত্যিই যুদ্ধে জড়াবে নাকি আবার পিছু সরে আসবে? সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে দুই দেশই প্রায় সমশক্তিধর বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। কথিত আছেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে অজেয় ভূমিকা রাখে। এদিক দিয়ে বিশ্লেষকরা পাকিস্তানকেই এগিয়ে রাখছেন। ভারত ২৮ টি অঙ্গরাজ্য নিয়ে গঠিত বিশাল ভূখন্ডের দেশ। অঙ্গরাজ্য গুলোর মধ্যেও দ্ব›দ্ব বিরাজমান। সেভেনসিস্টারস ভারত থেকে স্বাধীনতা অর্জনের ঘোষণা দিয়ে অনেকদিন ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়ে যাচ্ছে। কাশ্মীরও চায় তারা যেন স্বাধীন হয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। কিন্তু ভারত আগ্রাসী নীতির কারণে মুসলিম নিধনে বীভৎসতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। ভারতের সংখ্যালঘুদের হত্যাকান্ড ইসরাইলিদের মতো মানবতা বিবর্জিত।
ভারতের অভিযোগ পাকিস্তান জঙ্গিগোষ্ঠীকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায় ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমান নিধনের অজুহাত হিসেবে নিজেরাই এইরকম কর্মকান্ড ঘটিয়ে থাকে। এর জেরে ভারত মুসলমানদেরকে নির্যাতন নিপীডন ও বাস্তুহারা করে চলছে। এবার দেখার বিষয় ভারতের হুংকার নাকি সত্যি সত্যি তারা যুদ্ধে জড়াবে। যুদ্ধে জড়ালে কোনো দেশ কোনো দেশকে হয়তো ছাড় দিবে না। পারমাণবিক শক্তিধর দুটি রাষ্ট্রই সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে প্রায় কাছাকাছি। বরং পাকিস্তান এই যুদ্ধে হয়তো ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। বিশ্লেষকদের ধারণা ভারত যদি সত্যি সত্যি যুদ্ধে জড়ায় তাহলে নিজেদের বিপদ নিজেরা হয়তো ডেকে আনবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক