পূর্বদেশ ডেস্ক
জুলাই অভ্যুত্থানের গর্ভে জন্ম নেওয়া নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দিয়ে দলের আহব্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, তারা সামনের কথা বলতে চান, স্বপ্ন আর সম্ভাবনার বাংলাদেশের কথা বলতে চান। অতীতে বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে ‘দুর্বল করে রাখার চেষ্টা’ হয়েছে মন্তব্য করে সেই পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২৬ বছর বয়সী এই তরুণ নেতা। গতকাল শুক্রবার বিকালে ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে গঠিত দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। এনসিপির আংশিক কমিটি ঘোষণার পর সমাপনী বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি ঘোষণাপত্র পড়ে শোনান নাহিদ। খবর বিডিনিউজের
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা মনে করি, বাংলাদেশে যে বিভাজনের রাজনীতি তৈরি করে বাংলাদেশের জনগণকে দুর্বল করে রেখে, রাষ্ট্রকে দুর্বল করে রাখার যে ষড়যন্ত্র তৈরি হয়েছিল, সেই ষড়যন্ত্র আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সকলের ঐক্যের মাধ্যমে ভেঙে দিয়েছি। আমরা আজকের এই মঞ্চ থেকে শপথ করতে চাই, বাংলাদেশকে আর কখনও বিভাজিত করা যাবে না। বাংলাদেশে ভারতপন্থি-পাকিস্তানপন্থি কোনো রাজনীতির ঠাঁই হবে না। আমরা বাংলাদেশকে সামনে রেখে, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থকে সামনে রেখে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনীতি এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণ করব।’
নাহিদ বলেন, ‘আজকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে সামনের কথা বলতে চাই। আমরা পেছনের কথাকে অতিক্রম করে একটি সামনের সম্ভাবনার বাংলাদেশের, স্বপ্নের কথা বলতে চাই। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি। ছাত্র-জনতার মধ্য থেকে স্লোগান উঠেছিল, তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প। আজকে সেই বিকল্পের জায়গা থেকে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।’
এরপর নতুন দলের ঘোষণাপত্র পড়ে শোনান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব ছেড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে নাম লেখানো নাহিদ ইসলাম। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাবেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা হাজার বছরের ঐতিহাসিক পরিক্রমায় বঙ্গীয় বদ্বীপের জনগোষ্ঠী হিসেবে এক সমৃদ্ধ ও স্বকীয় সংস্কৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন ঘটে। তবে শোষণ ও বৈষম্য থেকে এ দেশের গণমানুষের মুক্তি মেলেনি। ফলে দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের জনগণকে বারবার গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয়েছে। ১৯৯০ সালে ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সামরিক স্বৈরাচারকে হটিয়েছে। তথাপি, স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়েও আমরা গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে— এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে পারিনি। বরং বিগত ১৫ বছর দেশে একটি নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল, যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে বেপরোয়া ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে। বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ, গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে একটি রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে পরিণত করা হয়েছে।’
নাহিদ বলেন, জুলাই ২০২৪-এ ছাত্র-জনতা বিপুল আত্মত্যাগের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে জেঁকে বসা ‘ফ্যাসিবাদী’ সরকারের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে, হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা কেবল একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই ঘটেনি। জনগণ বরং রাষ্ট্রের আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিলে, যেন জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়। সেই লক্ষ্য নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে দলটির আহব্বায়ক বলেন, ‘এটি হবে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল।’
বক্তৃতার এক পর্যায়ে নাহিদ বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সূচনা। একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদেরকে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সকল সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা ও তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে আমাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই কেবল আমরা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারব।
তিনি বলেন, নাগরিক পার্টি এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ চায়, যেখানে সমাজে ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ‘বিভেদের বদলে ঐক্য, প্রতিশোধের বদলে ন্যায়বিচার এবং পরিবারতন্ত্রের বদলে মেধা ও যোগ্যতার’ মানদÐ প্রতিষ্ঠিত হবে। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোনো স্থান সেই রাজনীতিতে হবে না। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে মূলধারায় তুলে আনা হবে। আমাদের রিপাবলিকে সাধারণ মানুষ, একমাত্র সাধারণ মানুষই হবে ক্ষমতার সর্বময় উৎস। তাদের সকল ধরনের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারের শক্তিশালী সুরক্ষাই হবে আমাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র। আমরা রাষ্ট্রে বিদ্যমান জাতিগত, সামাজিক, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও বৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে একটি বহুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই।
একটি ‘ন্যায্যতা ও সমতাভিত্তিক’ সমাজ প্রতিষ্ঠায় নাগরিক পার্টির সংকল্প ঘোষণাপত্রে তুলে ধরেন দলের আহব্বায়ক। তিনি বলেন, ‘চলুন আমরা একসঙ্গে, হাতে হাত রেখে, এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি যেখানে প্রতিটি নাগরিকের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হবে, যেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠা, মানুষের অধিকারের সংগ্রামই হবে রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য। যেখানে সাম্য ও মানবিক মর্যাদা হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। এখনই সময়—নতুন স্বপ্ন দেখার, নতুন পথচলার, এবং একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার!’