ভারতের সাথে সীমান্ত উত্তেজনা : দায় কার

3

জসিম উদ্দিন মনছুরি

১/১১ পরবর্তী ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ক্ষমতা গ্রহণের পর বিগত ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উন্নয়নের চেয়ে ভারতের উন্নয়নে বেশি মনোযোগী ছিলেন। ভারতের অদৃশ্য ইশারায় বিগত ১৬ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছিলো। বলা হয়ে থাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুমতি ছাড়া শেখ হাসিনা বিদেশ সফরেও যেতেন না। বিগত ১৬ বছরে ভারতের সাথে ২০ টি চুক্তি ও ৬৬ টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছেন। মূলত এই চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলি ভারতের কল্যাণেই সম্পাদিত হয়েছিল। শেখ হাসিনার উক্তি, ভারতকে যা দিয়েছি ভারত তা সারা জীবন মনে রাখবে। জনমনে প্রশ্ন জাগে ভারতকে কি এমন দিয়েছে? যার কারণে ভারত সারা জীবন শেখ হাসিনাকে মনে রাখবে? ২৪ জুলাই বিপ্লবের পর পাঁচ আগস্ট ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হয়ে ভারতে পলায়ন করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাগ গ্রহণ করে। দৈনিক আমার দেশে ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ভারতের সাথে সম্পাদিত দেশবিরোধী গোপন চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়। ভারতের সাথে সম্পাদিত গোপন চুক্তিগুলি ও সমঝোতা স্মারকের বিষয়ে জানা যায়। ক্ষমতায় থাকাকালীন শেখ হাসিনা বারবার ভারতে গমন করলেও চুক্তিগুলিকে জনগণের আড়ালে রাখা হয়েছিল। সা¤প্রতিক সময় ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে অবৈধভাবে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়াকে কেন্দ্র করে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। উল্লেখ্য যে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে ৪১৫৬ কিলোমিটার। তন্মধ্যে আওয়ামী সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সাল থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত অতি গোপনে বিএসএফ তিন হাজার ১৭১ কিলোমিটার বেড়া দিয়ে ফেলেছে। অথচ আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট বলা আছে দুই দেশের সীমান্ত রেখার দেড়শো গজের মধ্যে প্রতিরক্ষা বিষয়ক কিংবা উন্নয়নমূলক কোনো কর্মকান্ড করলে সে দেশের সাথেই আলোচনার ভিত্তিতে করতে হবে। কিন্তু ভারত আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে এসব বেড়া নির্মাণ করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারত অবৈধভাবে কাঁটাতারের বেড়া দিতে আসলে বাংলাদেশের জনগণ ও বিজেবির বাঁধায় ভারত পেছনের সরে যেতে বাধ্য হয়। ৮৮৫ কিলোমিটার বেড়া দেওয়ার জন্য ভারত উঠেপড়ে লেগে গেছে। ভারতকে বিভিন্ন ভাবে বিগত সরকার সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চারটি সীমান্ত সমঝোতা স্মারক সই করেন। ভারতের সাথে অসম চুক্তি সম্পাদন ও হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে। ভারতকে যেসব সুবিধা দেয়া হয়েছে তন্মমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
ভারতকে একতরফা ট্রানজিট সুবিধা প্রদান: ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদানের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে আওয়ামী সরকারের কোন কোন মন্ত্রীকে বলতে শুনা যায় ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর কিংবা দুবাই হয়ে উঠতে বেশি দেরি হবে না। কিন্তু বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরও হয়নি দুবাইও হয়নি। উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম- আখাউড়া- আগরতলা,মংলা আখাউড়া -আগরতলা, তামাবিল, ডাউকি, শেওলা সুতারকান্দি, বিবিরবাজার, সীমান্তপুর রুটে ১৬ টি ট্রানজিট রুট খোলা হয়েছিল। বাণিজ্য ঘাটতি অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায় ভারতকে শুল্কমুক্ত ব্যবসায়িক সুবিধা প্রদান করা হয়েছে ১৩৫ টি পণ্যে। ভারত বাংলাদেশে রপ্তানি করে প্রায় ৩৬০ টি পণ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশ রপ্তানি করে মাত্র ৩৬ টি পণ্য। বলা যায় বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশ ভারতের উন্মুক্ত বাজারে পরিণত হয়। ২০২৩ সালের জুলাই থেকেই ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ছিলো ৭১৬০ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলার। এই বাণিজ্য ঘাটতি ইতিহাসে বিরল বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র থেকে জানা যায় ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে স্থলপথে দুই দেশের মধ্যে ১ কোটি ৬০ লাখ ২৮ হাজার ৮০০ টন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি করা হয় ১ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৩ টন। এ সময় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় ৯ লাখ ৭৮ হাজার ৪৩৮ টন পণ্য। অর্থাৎ প্রায় ৯৪ শতাংশই ভারতের অনুকূলে।। চারটি নদী ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ট্রানজিট সুবিধা প্রদান ভারতের স্বার্থেই করা হয়েছে।
আদানির সাথে আত্মঘাতী বিদ্যুৎ চুক্তি প্রতিমাসের ৭০০ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। সে হিসাবে ২৫ বছরের চুক্তিতে ২৩ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার দিতে হবে যা দেশের সমুদয় রিজার্ভের চেয়েও বেশি। অথচ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদা সর্বোচ্চ ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াট। দেশীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোকে বিকল করে ভারতের স্বার্থে আদানি গ্রুপের সাথে আত্মঘাতী চুক্তি করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
তিস্তার পানি বন্টনে ভারতের স্বেচ্ছাচারিতা বাংলাদেশের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কুফল মাত্র। তিস্তার পানি ভারতের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে আদায় করার কথা বলে ভারতে গিয়ে শেখ হাসিনা পানির ন্যায্য হিস্যার কথা তোলেনওনি ।বরং ফেনী নদী থেকে ভারতকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসে। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক বই ভারতের ছাপাখানায় ভারতকে সুবিধা দেওয়ার জন্য ছাপা হতো । এর ফলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলি অকর্মন্য হয়ে পড়ে। জানা যায় মাধ্যমিক স্তরের ১ কোটি ৮৯ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য ২৩ কোটির বেশি কপি বইয়ের প্রয়োজন হয়।

প্রতিরক্ষা চুক্তি : এই চুক্তিতে ভারতের সঙ্গে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় চুক্তি করে বাংলাদেশ। এই প্রতিরক্ষা চুক্তির অন্তরালে রয়েছে ব্যাপক ফারাক। বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের অবাধ বিচরণ। দেশীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে বিপন্ন করার জন্য ভারতের চক্রান্তে ভারতের অনুগামী পুতুল সরকার ভারতকে ব্যাপকভাবে সুবিধার অংশ হিসেবে এসব সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে আসছিল। সীমান্ত হত্যা শেখ হাসিনার নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ফল। যেখানে দেশের শিক্ষিত ও বেকারদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলছে সেখানে ভারতের কয়েক লক্ষ মানুষ বৈধ ও অবৈধভাবে বাংলাদেশে চাকরি করেছে। ভারতে রেমিটেন্স প্রদানকারী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য বলছে ২০২০- ২১ অর্থবছরের দেশে কর্মরত বিদেশীরা ৯ কোটি ৪০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ নিজ দেশে পাঠিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা দাঁড়ায় ১১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের। আর এই টাকা পাঠানোর দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভারতীয়রা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে গত অর্থবছরের ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার রেমিটেন্স গেছে ভারতে। যা দেশের বাইরে যাওয়া রেমিটেন্স এর মধ্যে সর্বোচ্চ। এসব সুবিধা দিয়ে ভারতকে খুশি করে বিগত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ভারতের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে শেখ হাসিনা ভারতের কাছে বাংলাদেশের সব কিছু উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে। ভারতকে প্রভু মেনে ভারতের সুবিধায় দেশের সব কিছু উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে শেখ হাসিনা। তার নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে ভারত বাংলাদেশে সব সময় আগ্রাসী ভূমিকা পালন করে আসছে। বিএসএফের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। ভারতকে সন্তুষ্ট করতে বিগত আওয়ামী সরকার যেসব পরিকল্পনা নিয়েছিলো তার সবটুকুই করেছে। বাংলাদেশের জনগণকে সীমাহীন জুলুম,নির্যাতন করে ভারতের আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারত সেসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় পাগলামি শুরু করেছে। বিগত সরকারের অন্যায্য চুক্তির ফলে আজকে ভারতীয়রা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে সাহসী হচ্ছে। সীমান্ত উত্তেজনা, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া এটা শেখ হাসিনার ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার কুফল মাত্র। দেশপ্রেমিক বিজিবি ভারতের সকল অপকৌশল ব্যর্থ করে সাহসিকতার সহিত এগিয়ে যাচ্ছে। এখন সময় এসেছে সব অসম চুক্তি বাতিল করে নিজেদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার। শক্তি নিয়ে, সাহসী হয়ে, স্বাধীন- সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার। আশা করি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব অসম চুক্তি বাতিল করে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক