ভারতের ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন স্থগিত : স্থায়ী সমাধান কোন পথে?

1

মুহাম্মদ জাবেদ হোছাইন

ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দাবিদার এবং একই সঙ্গে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির গর্বিত ধারক। কিন্তু এই পরিচয়ের আড়ালে আজ যেন এক গোপন কান্নার সুর বেজে চলে, বিশেষ করে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের জীবনে। ইতিহাসের বাঁকবদলে বারবার যে জাতি ভারতের শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ও রাজনীতির ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছে; সেই মুসলিম স¤প্রদায় আজ এক গভীর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। কখনো উগ্রবাদী হামলার শিকার হয়ে, কখনো নীরব প্রশাসনিক বৈষম্যের মুখে, কখনো আবার আইনি প্যাঁচে বন্দি হয়ে। স¤প্রতি পাস হওয়া ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন এবং তা ঘিরে যে উত্তাল প্রতিবাদ, শেষপর্যন্ত সরকারের স্থগিতাদেশ এই পুরনো দুঃখগাথারই এক নতুন অধ্যায়।
ওয়াকফ মুসলিম সমাজের আত্মিক অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এক ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। শত শত বছর ধরে ভারতীয় মুসলিমরা মসজিদ, মাদরাসা, কবরস্থান, দরগাহ—সবকিছুর পেছনে ওয়াকফের আশ্রয় দেখেছে। অথচ ২০২৫ সালে প্রণীত নতুন সংশোধনী আইন যেন সেই ভীতকেই নাড়িয়ে দিতে উদ্যত হলো। অমুসলিমদের ওয়াকফ বোর্ডে অন্তর্ভুক্তি, দীর্ঘকাল ব্যবহারে ধর্মীয় সম্পত্তির স্বীকৃতি বাতিল, সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত ঘোষণা—এসব বিধান মুসলমানদের হৃদয়ে গভীর সংশয়ের সঞ্চার করে। ধর্মীয় জীবন ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার যে অদৃশ্য বাঁধন, তা যেন রাষ্ট্রীয় নিয়মের কাঁচি দিয়ে ছিন্ন করার প্রয়াস শুরু হলো!
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভারতীয় মুসলমানরা চুপ করে থাকার জাতি নয়। সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উত্তাল বিক্ষোভ গড়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের জনসমুদ্র, কর্নাটকের প্রতিবাদমিছিল, কেরালার মানববন্ধন—সব মিলিয়ে গোটা উপমহাদেশ যেন এক দাবানলে জ্বলতে থাকে। বিক্ষোভের ঢেউ কেবল রাস্তায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, আইন অঙ্গনে গিয়েও প্রবল প্রতিধ্বনি তোলে। সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ হয় আইনটি। আর অবশেষে, গণচাপ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ভারত সরকার আইনটির কার্যকারিতা স্থগিত করতে বাধ্য হয়।
তবে ইতিহাসের অভিজ্ঞতা বলে-স্থগিতাদেশ মানে তো বাতিল নয়! সাময়িক চাপের কাছে মাথানত করা হয়েছে মাত্র। মুসলিম সমাজ তাই আজও উদ্বিগ্ন; জানে না, কখন আবার অন্য কোনো নামে, অন্য কোনো চেহারায় ফিরে আসবে সেই হুমকি।
আসলে ভারতের মুসলমানরা বহুদিন ধরেই এক অন্তহীন শোষণের চক্রে আবদ্ধ। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের কথা কে ভুলতে পারে? উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় দাঁড়িয়ে থাকা চারশ বছরের পুরনো বাবরি মসজিদ, যেটিকে একদা সম্রাট বাবর নির্মাণ করেছিলেন, সেটিকে নির্মমভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো হাজারো উগ্র হিন্দুত্ববাদীর হাতে। মসজিদটি ধ্বংস হলো আর তার সাথে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার গর্বও এক গভীর ক্ষত নিয়ে রক্তাক্ত হলো। সেদিন শুধু একটি স্থাপনা ধ্বংস হয়নি, ভেঙে গিয়েছিলো মুসলিম সমাজের আস্থা রাষ্ট্রের ন্যায্যতার প্রতি, আইনের শাসনের প্রতি, সহাবস্থানের স্বপ্নের প্রতি।
এরপর থেকে যেন প্রতিটি দশক ছিল মুসলিম নিপীড়নের একেকটি অধ্যায়। গুজরাটের ২০০২ সালের দাঙ্গা, মব লিঞ্চিংয়ের ভয়াবহতা, লাভ জিহাদ-বিরোধী আইন, হিজাব নিষিদ্ধকরণ-প্রতিটি ঘটনায় মুসলমানরা টের পেয়েছে, তারা ক্রমেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হচ্ছে। শিক্ষার অধিকার, জীবিকার অধিকার, এমনকি প্রাণের অধিকার-সবকিছু যেন প্রশ্নের মুখে।
ওয়াকফ আইনের সংশোধন ছিল এই ধারাবাহিকতারই আরেকটি রূপ। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, শতাব্দীপ্রাচীন মসজিদ-মাদরাসাগুলো আজ আইনি কৌশলের মাধ্যমে দখলের মুখে পড়েছে। সরকারি বাহিনীর হাতে কখনো অবৈধ স্থাপনা বলে, কখনো আবার ভূমি উন্নয়নের অজুহাতে মাদরাসা ধ্বংস করা হয়েছে। অথচ সংবিধানের ২৫, ২৬ ও ৩০ নম্বর অনুচ্ছেদে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় ও শিক্ষাগত অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ছিলো।
এক্ষেত্রে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (ঈঅঅ) এবং আসামে এনআরসি (ঘজঈ) প্রক্রিয়ার কথাও ভুলে যাওয়া যায় না। এসব উদ্যোগ মুসলিম সমাজের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কে ভারতীয়? কার এখানে থাকার অধিকার আছে? এই প্রশ্নগুলো আজ মুসলমানদের প্রতিদিনের জীবনের অনিবার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক পরিসরেও ভারতের নীতির বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদ উঠেছে বটে; কিন্তু তা যথেষ্ট ছিলো না। বড় বড় রাষ্ট্রগুলো, ভারতের বিশাল বাজার আর ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের লোভে নীরব থেকেছে। এমনকি মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশও আর্থিক স্বার্থে অথবা ক‚টনৈতিক হিসাব-নিকাশে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলে ভারতের মুসলিমরা নিজেদের যুদ্ধ নিজেরাই লড়েছে-রাস্তায়, আদালতে, কলমে, হৃদয়ে।
আজকের বাস্তবতায় আরও একটি গভীর আশঙ্কা দানা বাঁধছে ধর্মীয় বৈষম্যের পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বেড়ে চলেছে। শিক্ষার ক্ষেত্র থেকে শুরু করে সরকারি চাকরি, শিল্প, ব্যবসা-প্রতিটি স্তরেই মুসলমানরা ক্রমেই কোণঠাসা হচ্ছেন। মুসলিম লেখকদের লেখা পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়ে তাঁরা এক ধরনের ‘অদৃশ্য জাতি’-তে পরিণত হচ্ছেন, যার অস্তিত্ব শুধুই পরিসংখ্যানের পাতায়, বাস্তব উন্নয়নচিত্রে নয়। এই বঞ্চনা যদি অব্যাহত থাকে, তবে তা শুধু মুসলমানদের নয়, গোটা ভারতের সামাজিক ভারসাম্য ও অগ্রগতির জন্যই এক গভীর সংকট ডেকে আনবে।
তবে হতাশার অন্ধকারের ভেতরেও আশার কিছু দীপ্ত রেখা দেখা যায়। আজকের প্রজন্মের শিক্ষিত মুসলমানরা লেখাপড়ার জগতে, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে, ব্যবসায়ে এবং সামাজিক উদ্যোগে নিজেদের অবস্থান গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন। সুশিক্ষা, সচেতনতা ও সংগঠিত প্রতিবাদের মাধ্যমে তাঁরা ভবিষ্যতের জন্য এক বিকল্প দিশা নির্মাণ করছেন। হয়তো সময় লাগবে, সংগ্রাম কঠিন হবে; কিন্তু ভারতের মাটিতে মুসলিম সমাজের টিকে থাকা, এগিয়ে যাওয়া এটি ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী ধারাবাহিকতা হয়ে উঠবে।
তবে এতো নিপীড়ন, এতো বৈষম্যের মাঝেও ভারতীয় মুসলমানরা হার মানেনি। তাদের মসজিদে আজান উঠেছে, মাদরাসায় কোরআন তিলাওয়াত হয়েছে, সাহিত্যসভায় উর্দু কবিতা ধ্বনিত হয়েছে। প্রতিটি নিপীড়নের বিপরীতে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। তারা প্রমাণ করেছে—সংখ্যায় তারা কম হতে পারে; কিন্তু তাদের মনোবলে কোনো ঘাটতি নেই।
আজ যখন ওয়াকফ আইন স্থগিত হয়েছে, এটি নিছক একটি আইনি সিদ্ধান্ত নয়-এ এক প্রতীকী বিজয়। একটি ক্ষতবিক্ষত, ক্লান্ত; কিন্তু অদম্য জাতির আত্মমর্যাদার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তবে সংগ্রাম এখানেই শেষ নয়; বরং এটি নতুন লড়াইয়ের আহবান—একটি ন্যায়ভিত্তিক, সমানাধিকারের, সত্যিকার অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের জন্য।
ভারতের মুসলিমরা কেবল কোনো ধর্মীয় স¤প্রদায় নয়। তাঁরা ভারতের ইতিহাস, শিল্প, ভাষা ও সংস্কৃতির অনিবার্য অঙ্গ। তাঁদের বাদ দিলে ভারত যে অপরিপূর্ণ থেকে যাবে, তা ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে। তাই সময় এসেছে, ধর্মীয় বিদ্বেষের অন্ধকার সরিয়ে দিয়ে ঐক্য ও সহাবস্থানের আলো জ্বালানোর। সময় এসেছে, বিভেদের প্রাচীর ভেঙে ভ্রাতৃত্বের সেতু গড়ার। আর সেই নির্মাণের প্রথম ইট হতে হবে ন্যায়, মানবতা ও সমানাধিকারের অটল অঙ্গীকার।

লেখক : ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক