ভারতীয় অর্থনীতির মন্থরগতি

37

এমন কি ভারতের বড় বড় অর্থনীতিবিদরাও অল্প কিছুদিন আগেও মনে করতেন ভারতের চলমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত গতিতে চলবে। কেননা এক দশক ধরে ভারতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার ৯ শতাংশের নিচে নামে নাই। ২০০৮ সালের আগে থেকে যখন সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা আরম্ভ হয়েছিল তখনও ভারতীয় অর্থনীতি বার্ষিক ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার সক্ষমতা দেখিয়েছিল। এই হারে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই সম্পূর্ণ সময়টাতেই ড. মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে ভারতীয় কংগ্রেসই ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। ভারতের প্রায় অর্থনীতিবিদদের ধারণা ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার এর থেকে না কমলেও কমার সম্ভাবনা সেই। সে সময়ে বিপুল ভোটের জয়ী হয়ে বি.জে.পি. নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ক্ষমতায় সমাসীন হলেন। আসলে এরপর থেকে ভারতের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার কমতে শুরু করে। ক্ষমতায় এসে ‘হিন্দুত্ববাদ’ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে বিজেপি ও হিন্দু মহাসভা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান এমনভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অর্থনীতির সূ² ব্যাপারগুলি তাদের চিন্তায় ছিল না। অনেক দিন ধরে দেশের অর্থনীতিবিদরাও আঁচ করতে পারেন নাই বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ভয়ে স্পষ্টভাবে মুখ খুলেন নাই।
একদিন হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী নিজেই হাজার টাকার নোট বাতিলের ঘোষণা ছিলেন, তিনি বললেন অঘোষিত সম্পদ বের করার জন্য এইপদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ভারতের নোবেল পুস্কার বিজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্যসেন থেকে নিয়ে ভারতের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদেরা এই ব্যাপারে একমত যে বড় মূল্যমানের নোট বাতিলের এই সিদ্ধান্ত ছিল মারাত্মক একটি সর্বনাশা ভুল পদক্ষেপ। ইহার ফলে ভারতীয় অর্থনীতির উপর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে তার পরিণতি অনেক বৎসর ধরে ভারতের সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রতিফলন ঘটবে। একটি দেশের মুদ্রা বাজার থেকে প্রায় ৮৬ শতাংশ মুদ্রা বাতিল করে কোন অর্থনীতিবিদ যমি মনে করেন এই পদক্ষেপের দ্বারা সংশ্লিষ্ট অর্থনীতি উপকৃত হবে সেক্ষেত্রে অর্থনীতিতে তাঁর জ্ঞানের পরিধি দেখে যে কোন সত্যিকার অর্থনীতিবিদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
সাধারণত, একটি অর্থনীতিতে কালো টাকা ৬ থেকে ৭ শতাংশ বেশি থাকেনা। আর যাদের কাছে কালো টাকা থাকে তারা এত বেশি প্রভাবশালী হয়ে থাকে যে তাদের কাছে গচ্ছিত কালো টাকা সাদা করতে ৫/১০ মিনিটের বেশি সময় লাগেনা। আসলে নোট বাতিল করাতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা হলো ছোট ও মাঝারী শ্রেণীর ব্যবসায়ী। যাই হউক যখন ভারত সরকার বুঝতে পারলেন এই পদক্ষেপের ফলে কালো টাকা বন্ধ হওয়া দূরে থাক বরং ভারতীয় সমগ্র অর্থনীতির যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। তখন ঘোষণা করা হলো ক্যাশবিহীন (ঈধংযষবংং) অর্থনীতি চালু করার জন্য সরকার নোট বাতিলের এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। ইহাতে অর্থনীতিতে সংশ্লিষ্টদের অজ্ঞতা আরও প্রকটভাবে প্রকাশ পেলো। আর লোকসংখ্যার একটা বিরাট অংশ এখনও নিরক্ষর সেখানে ক্যাশহীন লেনদেনের কথা আরেকজন নিরক্ষরের পক্ষে বলা সম্ভব। ভারতীয় অর্থনীতিবিদরা এই ব্যাপােের একমত যে মোদী সরকারের নোট বাতিল করাও ভারতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের গতি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। নোট বাতিলের সে ধাক্কা এখনও ভারতের অর্থনীতি কেটে উঠতে পারে নাই। ছোট ছোট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান যে সব প্রতিষ্ঠানে ২ থেকে ৫ জন কর্মচারী রয়েছে। প্রতিদিনের বেচা কেনার উপর তাদের বেতন পাওয়া নির্ভর করে। নোট বাতিলের ফলে সে সব প্রতিষ্ঠানগুলি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে এবং লক্ষ লক্ষ লোক চাকরী হারা হয়ে গেছে।
বর্তমানে ভারতীয় অর্থনীতির প্রতি সেক্টরে উদ্বেগজনক মন্দার খবর। গত ৪৫ বৎসরের মধ্যে বর্তমানে ভারতের সবচাইতে বেশি বেকারত্ব সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান সময়ে বেকারের হার হলো ৮.৪ শতাংশ যা হ্রাস পাওয়ার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছেনা বরং অদূর ভবিষ্যতে এই হার আেরও বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কৃষি ক্ষেত্রে কৃষকের আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সরকার এখন বাড়তি আত্মহত্যার সংখ্যা যাতে গণমাধ্যমে না আসে তার জন্য সকল সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই বৎসরের আগস্ট মাসে আটটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পখাতে ০.৫ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে। তন্মমধ্যে কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট, সার, ইস্পাত, সিমেন্ট এবং বিদ্যুৎ ইত্যাদি।
ইতিমধ্যে ভারতের ব্যাংকগুলি অকেজো সম্পদের চাপে টলটলায়মান এবং ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশী বিল্ডারদের কাছে ঋণ দেওয়া আছে। অথচ এপার্টমেন্টের দাম এত কমে গেছে যাকে শূন্যের কোটা বলে অভিহিত করা যায়। এই পরিস্থিতি ব্যাংক ঋণ দিতে ভয় পাচ্ছে এবং বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছে। এই অবস্থায় অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনিভূত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কেমন করে আসবে তা বুঝা অর্থনীতিবিদদের পক্ষেও কঠিন হয়ে পড়েছে। গত আগস্ট মাসে গাড়ীর ক্রয় বিক্রয় ও প্রায় ৩২ শতাংশে নেমে এসেছে। গত দুই দশকে এর চাইতে গাড়ীর চাহিদা আর কোন সময়েই কমে নাই। কেন্দ্রীয় সরকারের এবং রাজ্য সরকার উভয়ের গাড়ীর ব্যাপারে অনুসৃত নীতির ফলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছৈ। ইহা ছাড়াও গাড়ীর উপর লক্সারী ট্যাক্স বসানো হয়েছে। বর্তমানে ভারতের যে কোন ব্যাংক এবং ফাইনান্স কোম্পনাীগুলি গাড়ীর জন্য ঋণ বরাদ্ধ দিতে চরম অনীহা প্রকাশ করছে। গত ৪৫ বৎসরের মধ্যে বর্তমানে সরকারের নেওয়া ভ্রান্ত নীতির ফলে অটোমোবাইল মার্কেট প্রায় বন্ধ যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বাজারে প্রায় প্রত্যেকটা দ্রব্যের ক্ষেত্রে এই অবস্থা চলছে। প্রায় ভারতীয়দের সখের খাদ্য হলো চা দিয়ে বিসক্্িট খাওয়া,তার বিক্রয় ও সর্বমোট ৮ শতাংশ কমে গেছে। আমেররিকার রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মি: এলন গ্রীনস্পেন একটি দেশের অর্থনৈতিক মন্দাভাব নিরীক্ষার জন্য সে দেশে ‘আন্ডার-ওয়্যারের’ দাম যাচাইয়ের সুপারিশ করেছিলেন। সম্প্রতি ভারতের তামিল নাডু রাজ্যের ত্রিপুর নামক স্থানে, যে স্থানকে গার্মেন্টস এর রাজধানী হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। সেখানে পুরুষের আন্ডারওয়ারের মূল্য ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
ভারতের এই ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী মোদিজি আমেরিকায় অবস্থানের সময়, আমেরিকার হস্টন শহরে প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মত ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকার নাগরিক জমায়েত করে ট্রাম্প সাহেবকে সম্বর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং ঐ সম্বর্ধনা সভায় মোদী নিজেই ভাষণ দিয়ে ভারতীয়দেরকে আমেরিকার আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে সমর্থন করার উদাত্ত আহŸান জানিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করে ট্রাম্পের জন্য এক বড় কাজ করেও তিনি ট্রাম্পের মন নরম করতে পারেন নাই। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকায় ভারতীয় রপ্তানী পণ্যগুলির উপর যে শুল্ক কর বৃদ্ধি করেছে, নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয়দের দ্বারা এত বড় সম্বর্ধনা আয়োজন করার পরও ট্রাম্প সাহেব নমনীয় হন নাই। ভারতীয় পণ্যের উপর শুল্ক হ্রাস করা হয় নাই।
গত মে মাসে অনুষ্ঠিত ভারতীয় সাধারণ নির্বাচনে আগের চাইতেও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে মুদিজি ক্ষমতায় ফিরে আসার পর ভারতীয় এবং বিদেশি পুঁজিবিনিয়োগকারীরা মনে করেছিলেন এবার ভারতে পুঁজি বিনিয়োগ বাধাগুলির ব্যাপারে তিনি সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। কিন্তু বর্তমান বাজেটে দৃশ্যত কোন দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নাই। দীর্ঘমেয়াদী ইস্যুগুলি যেমন নিশ্চল কৃষিখাত, কঠোর শ্রমিক আইন এবং জমির অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্য এসব দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলি সম্পর্কে সরকারের কোন উচ্চ বাক্য পরিলক্ষিত হচ্ছেনা।
অর্থনীতির এই পতনের ফলে বাজেটে নির্ধারিত ট্যাক্স আদায় হচ্ছেনা সে জন্য টেক্স অফিসারদের তৎপরতা বেড়ে গেছে এবং প্রায় ব্যবসা অফিসে টেক্স অফিসারদের অনাহূত প্রবেশ বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা সেটাকে “ঞধী ঃবৎৎড়ৎরংস” বা টেক্স সন্ত্রাস বলে নামকরণ করেছে। ইদানীং ভারতীয় মিলিয়নরা বিদেশে পাড়ি জমাতে আরম্ভ করেছে। গত বৎসরের হিসাব অনুযায়ী ৫০০০ মিলিয়নরা দেশত্যাগ করেছে। এই বৎসর আরো বেশি সংখ্যায় দেশ ত্যাগ করবে বলে ভবিষ্যৎবাণী করা হচ্ছে।

লেখক : কলামিস্ট