ভাঙছে সিডিএসপি বাঁধ দিশেহারা মৎস্য চাষীরা

2

এম আনোয়ার হোসেন, মিরসরাই

মিরসরাইয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা বঙ্গোপসাগরের ভাঙ্গন থেকে রক্ষা করতে ১৯৯৪ সালে চর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্টের (সিডিএসপি) আওতায় ১১.৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এতে বাঁশখালী ও ইছাখালী এলাকায় গড়ে উঠে শত শত একর মৎস্য প্রকল্প। এই বাঁধ পরিচিতি লাভ করে ‘সিডিএসপি বাঁধ’ হিসেবে। এই বাঁধকে ঘিরে বদলে গেছে এখানকার চিত্র। গড়ে উঠেছে শত শত মৎস্য প্রকল্প। এসব মৎস্য প্রকল্পে চাষাবাদ করে ভাগ্য বদলেছে অসংখ্য মানুষের। বিগত কয়েক বছর আগেও বাঁধ থেকে প্রায় ৩ হাজার মিটার দূরেও মৎস্য চাষ হতো। কিন্তু বাঁধটি ভাঙনের ফলে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে ২৫টি মৎস্য প্রকল্প। গত কয়েকদিনে সিডিএসপি বাঁধের একাংশ নদীতে ভেঙ্গে পড়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়েছে, ভেঙ্গে গেছে কয়েকটি বিদ্যুতের খুঁটি ও সড়কের পাশের অসংখ্য গাছ-গাছালী। দ্রæত বাঁধের ভাঙন ঠেকানো না গেলে পথে বসবেন অসংখ্য মৎস্য উদ্যোক্তা ও চাষী।
জানা যায়, এখান থেকে চট্টগ্রামের মাছের চাহিদার ৭০ শতাংশ জোগান দেয়া হয়। অপরদিকে ফেনী, মুহুরী ও কালিদাস নদীর সম্মিলিত পানি প্রবাহকে সেচ কাজে লাগাতে এবং ফেনী, সোনাগাজী ও মিরসরাই এলাকাকে বন্যা ও ভাঙনের হাত থেকে রক্ষায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প মুহুরী সেচ প্রকল্প করা হয়। ১৯৭৭-৭৮ অর্থ বছরে শুরু হয়ে ১৯৮৫-৮৬ অর্থ বছরে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। ইতোমধ্যে ফেনী নদীর ভাটি এলাকায় পলি জমায় মুহুরী সেচ প্রকল্প কার্যকারিতা হারাতে বসেছে। এতে চট্টগ্রাম ও ফেনী সীমান্তবর্তী ফেনী নদীর স্বাভাবিক গতিও বদলে গেছে। ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সিডিএসপি বাঁধ। অথচ এই বাঁধ দেওয়ার পর এখানকার মানুষ আশায় বুক বাঁধে। গড়ে তুলেন শত শত মৎস্য প্রকল্প, প্রকল্পে ভাগ্য বদলেছে বেকার তরুণসহ অসংখ্য মানুষের। কিন্তু সিডিএসপির বাঁধ ভাঙনের ফলে তারা এখন দিশেহারা। ভাঙনের তীব্রতার কারণে অনেকেই মৎস্য চাষ বন্ধ রেখেছেন। ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে বেশকিছু বিদ্যুতের খুঁটি ও সড়কের পাশের গাছ-গাছালী। সিডিএসপির বাঁধ পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে গেলে চলতি বর্ষা মৌসুমে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেবে। পাশের এলাকার মানুষ হারাবে ভিটেবাড়ি, কৃষক হারাবে জমি, নদী গর্ভে বিলীন হবে মৎস্য প্রকল্প। ভাঙনের স্বল্প দূরত্বে বাস্তবায়িত হতে যাওয়া দেশের সর্ববৃহৎ জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন কাজও কিছুটা ঝুঁকিতে পড়বে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের আগস্ট মাসে সিডিএসপি বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে নদীতে বিলীন হয়। তখন ভাঙা অংশে নদীর প্রবাহ অন্য দিক দিয়ে ঘুরিয়ে বাঁধ নতুন করে নির্মাণ করা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, মুহুরী সেচ প্রকল্পের ভাটিতে প্রায় ১১ শত বর্গমিটার এলাকায় পলির স্তর জমেছে। এতে নদীর প্রবাহ পথ বদলে সোনাগাজীর থাক খোয়াজের লামছিতে ছোট ছোট চর জেগেছে। অপরদিকে মিরসরাই অংশের উত্তর ইছাখালী অংশে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। পলি জমার কারণে মুহুরী সেচ প্রকল্পের বেশ কিছু স্লুইচ গেট কাজে আসছে না। সিডিএসপি বাঁধের উত্তর অংশের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা ফেনী নদীর অববাহিকায় পড়েছে। বাকি অংশ বঙ্গোপসাগর অববাহিকায়। একসময় নদী ও সাগর থেকে বাঁধের দূরত্ব ছিল প্রায় ৩ হাজার মিটার। বর্তমানে এই দূরত্ব কোথাও ১০ মিটার, কোথাও ৫ মিটার। তবে বিভিন্ন সময় ভাঙনরোধে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সিসি বøক দেওয়া হলেও সেগুলো নদী গর্ভে চলে গেছে। দ্রæত সময়ের মধ্যে সিডিএসপি বাঁধের পশ্চিম পাশে সুরক্ষা বøক না বসালে চলতি বর্ষায় এখানকার বহু মৎস্য প্রকল্প নদী ভাঙনে তলিয়ে যাবে।
মিরসরাইয়ের ওচমানপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আতা উল্ল্যাহ রনি বলেন, ‘২০১৯ সালের শুকনো মৌসুমে মুহুরী সেচ প্রকল্পের মুখে বালু ও মাটি জমা শুরু হয়। ওই বছরের বর্ষায় ভাঙন শুরু হয়। এর আগে প্রায় ৩ দশকেও এমন ভাঙন দেখা যায়নি। বর্তমানে ভাঙনের মাত্রা বহুগুণে বেড়েছে। এতে করে এখানকার মৎস্য প্রকল্পগুলো বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমরা এই বাঁধ দ্রুত সংস্কারের বিষয়ে প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি’।
স্থানীয় কৃষক হোসেন আহম্মদ বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকে এই নদীর আচরণ দেখে আসছি। মুহুরী প্রকল্পের ভাটিতে যে পলি জমেছে তা খনন করলে ভাঙনরোধ করা সম্ভব হবে। আমার বয়সেও এখানে এমন ভাঙন দেখিনি। মূলত পলি জমার কারণে ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না’।
ইছাখালী ইউনিয়নের মৎস্য চাষী মাঈন উদ্দিন বলেন, ‘সিডিএসপি বাঁধ দেওয়ার পূর্বে নদী প্রায় ৩ হাজার মিটার দূরে ছিল। বাঁধ দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল এখানকার ফসলি জমি ও বসতবাড়ী লবণাক্ত পানি ও বন্যার পানি থেকে মুক্ত রাখা। বাঁধ ভেঙ্গে গেলে বাঁধের পূর্ব পাশের ১০-১২ টি গ্রামে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়বে’।
স্থানীয় সিএনজি অটোরিকশাচালক শেখ ফরিদ বলেন, ‘বাঁধের কিছু অংশ ভেঙ্গে নদীতে পড়ে যাওয়ার কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বাঁধের যে অংশ এখন আছে তাতেও বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে, সেগুলোও যেকোনো মুহুর্তে নদীর জলে তলিয়ে যাবে। দ্রুত এটি সংস্কার না করা গেলে কয়েকদিন পর হাঁটার পথও বাকি থাকবে না’।
মৎস্য চাষী মীর হোসেন রাহাত বলেন, ‘এই বাঁধ দেওয়ার পর আমার মতো শত শত যুবক মৎস্য চাষে এগিয়ে আসে। মৎস্য চাষ করে অসংখ্য বেকার যুবক ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে। বাঁধের ভাঙন রোধ দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন না করলে অনকে মৎস্য চাষী পথে বসতে হবে’।
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ রাসেল বলেন, ‘বাঁধের ভাঙনের পাশে স্থাপন করা প্রায় ১০-১৫টি বিদ্যুতের খুঁটি নদীতে ভেঙ্গে পড়েছে। বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙ্গে পড়ার পর এখানকার বেশকিছু মৎস্য প্রকল্প বিদ্যুতহীন হয়ে পড়েছে। এতে করে তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে’।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহফুজা জেরিন বলেন, ‘আমি আগে কয়েকবার ওই বাঁধ পরিদর্শন করেছি। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ারের সাথে কথা বলবো এই বিষয়ে যেন দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেবে’।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অলোক দাশ বলেন, ‘সিডিএসপি বাঁধের ভাঙনের বিষয়টি আমার জানা নেই। যেহেতু এখন শুনেছি দু’য়েকদিনের মধ্যে ভাঙন অংশ পরিদর্শন করবো। সরেজমিনে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।