ভয়াবহ অবস্থায় রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নিন

2

ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গত ২২ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ডেঙ্গু আক্রমণে একদিনেই মৃত্যুবরণ করেছে ৭জন। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নতুন ভর্তি হয়েছে ১১৩৯। এ নিয়ে চলতি মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতমাসে সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে ৮০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল। চলতি বছর ডেঙ্গুতে ২৫৭ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া সাতজনের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে দুজন ও খুলনা বিভাগের (সিটি করপোরেশনের বাইরে) দুজন রয়েছেন। বাকি তিনজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বাদে ঢাকা বিভাগ ও বরিশাল বিভাগে মারা যান। চট্টগ্রামে প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় সিভিল সার্জন কার্যালয় নগরীর ৬টি এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করা হয়েছে। রেড জোন হিসেব তালিকাভুক্ত এলাকাগুলোর মধ্যে কোতোয়ালিতে সর্বোচ্চ ১০৬ জন, বাকলিয়ায় ১০৩ জন, বায়েজিদ বোস্তামীতে ৭৬ জন, বন্দরে ৩৩ জন, পাহাড়তলীতে ৩২ জন এবং খুলশীতে ২৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
এছাড়া আরও পাঁচটি এলাকাকে ‘ইয়েলো জোন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, যা সংক্রমণের মাঝারি উচ্চ ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়। সাতটি এলাকাকে ‘বøু জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা মৃদু ঝুঁকির সংকেত দেয়। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী শ্রেণীকরণের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও এলাকাবাসীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমরা ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি এমন এলাকাকে রেড জোন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছি। আমরা সিটি করপোরেশনকে জানিয়েছি এবং এসব এলাকায় নিবিড়ভাবে মশক নিধন কার্যক্রমের দিকে নজর দেওয়ার আহŸান জানিয়েছি। জনগণকেও সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।’ দেশব্যাপী গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ১৩৯ জন নতুন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ঢাকা বিভাগের মানুষ, ২৫৫ জন। আক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুও বাড়ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশতি প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে চলতি বছর এখন পর্যন্ত নতুন করে প্রায় আড়াইশ মানুষরে মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে। রোগটির প্রকোপের বর্তমান পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। গড়ে সাত-আটজনের মৃত্যু হচ্ছে প্রতিদিন। শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তিও গড়ে হাজারের বেশি। চলতি বছর মৃতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম মানুষ, যা দুই-তৃতীয়াংশ। অর্থাৎ যাদের আয়ের ওপর নির্ভর করে পরিবার। যদিও কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়, তবুও ডেঙ্গুতে এসব কর্মক্ষম মানুষের চলে যাওয়া সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোকে যে বশিাল অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়, তা বলাই বাহুল্য। সারাদেশে রোগটি ছড়িয়ে পড়ার জন্য মশকনিধনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু বেশি হওয়ার নেপথ্যে অবহেলা সবচেয়ে বেশি দায়ী করছেন তারা। জ্বর জ্বর অনুভব করলেও কাজ ফেলে কেউ যাচ্ছে না ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে। ফলে রোগটি নীরবে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে আক্রান্ত ব্যক্তিকে। পরিস্থিতির অবনতি হলে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে এলেও শেষরক্ষা হয় না।
আমরা জানি, গত দুই দশকেরও অধিক সময়ে বহু মানুষরে মৃত্যু হয়েছে রোগটিতে। রোগটির প্রকোপ সাধারণত শহরকেন্দ্রীক হলেও এখন এর বিস্তার সারা দেশে। শুধু তাই নয়, একসময় যা ছিল বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এখন তা প্রায় সারা বছররে সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ ডেঙ্গুর প্রকৃতি ও ধরন পাল্টাচ্ছে। একই সঙ্গে পাল্টাচ্ছে এটি মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জ। এ নিয়ে নানা উদ্যোগ, পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে এসবে বরাবরই অনুপস্থিত ছিল উপযুক্ত ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। মশা মারতে কামান দাগিয়ে সিটি কর্পোরেশনের ব্যাপক অর্থ ব্যয়ের খবর আমরা পেয়ে থাকি বটে এডিম মশার নিয়ন্ত্রণ হতে দেখা যায় না।
আমাদরে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতাসহ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো বশে কয়কেটি দেশের এডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে সফলতার কথা অজানা নয়। আমরা মনে করি, দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ সময় ধরে চলমান অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মশক নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা, স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতা প্রধানত দায়ী। ফলে এটি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের সমন্বিত উদ্যোগের পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতাও জরুরি। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগের ক্ষেত্রে যে সব দেশ ডেঙ্গু মোকাবিলায় সক্ষম হয়েছে, আমাদের দেশের বাস্তবতায় সেসব মডেল উপযুক্ত কি না এবং তা স্থায়ী সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে পারবে কি না, তা গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত। আমাদের প্রত্যাশা, ছাত্র-জনতার অন্তর্বর্তী সরকার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী সমাধানরে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ জন্য দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন-এমনটি প্রত্যাশা নগরবাসীর।