ভক্ত ও ভগবানের মহামিলন উৎসব রথযাত্রা

1

উত্তম কুমার চক্রবর্ত্তী

আষাঢ়ের এইদিনে করুণা করে তিনি নেমে এলেন তাঁর প্রিয় ভক্তদের দেখার জন্যে অতি সাধারণের মতো। কোন নামী দামী গাড়িতে চড়লেন না, এসি গাড়ীতে উঠলেন না। ভক্তের আহবানে সাড়া দিয়ে আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথে উঠে ভগবান যাত্রা করলেন ধরণীর বুকে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে। তাঁর এই যাত্রার নাম হলো রথযাত্রা। প্রাচীন গ্রন্থ ব্রহ্মান্ড পুরাণে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, রথযাত্রার প্রচলন সত্যযুগেই হয়েছে। সেইসময় উড়িষ্যা মালবদেশ নামে পরিচিত ছিল। সেই মালবদেশের সূর্যবংশীয় পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুন্ম স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণুর জগন্নাথরূপী মূর্তি নির্মাণ করেন এবং তিনি রথযাত্রারও স্বপ্নাদেশ পান। পরবর্তীতে তাঁর হাত ধরেই পুরীতে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন হয়। বাংলায় রথ প্রচলনের প্রেক্ষাপট আবার ভিন্ন। যুগাবতার শ্রীশ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নীলাচল থেকে এই ধারা বাংলায় নিয়ে আসেন। তাই বাংলায়ও রথযাত্রা উৎসব অধিক জনপ্রিয়।
ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য আর আচার প্রথার মাধ্যমে রথযাত্রার এই আয়োজন আজ মহা উৎসবে রূপান্তরিত। শুধু ভগবানকে প্রাণভরে দেখার জন্য, তাঁর রথের রশি ধরে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ভক্তের নিরলস আকুলতা। তাঁর যাত্রায় সহযাত্রী হয়ে নিজে ধন্য হবার মানসে ভক্তের নিরন্তর প্রচেষ্টা। ভক্তাধীন ভগবান । তাই এই পুণ্যময় দিনটি ভগবান ও ভক্তের মিলনের এক অপূর্ব মহাউৎসব। রথে চড়বেন অনাদির আদি গোবিন্দ জগন্নাথ রূপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। আরেকটিতে বলরাম তথা বলভদ্র এবং অন্যটিতে বোন সুভদ্রাদেবী। এই যেন ভাইবোনের একত্রে যাত্রা যা ভালোবাসাপূর্ণ সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। আমাদের জাগতিক জীবনেও তথা প্রতিটি পরিবারে ভাইবোনের মধ্যে প্রীতিময় সুন্দর সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। যা থাকলে একটি পরিবার সুষ্ঠু পরিবার হিসেবে গড়ে উঠবে। শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রায় আমরা তাঁর হাত পা কিছুই দেখি না। কেনই বা এমন দেখি? তার কারণ হলো বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে যিনি সর্বত্র বিরাজমান এই ক্ষুদ্র রথে তাঁর হাত পা রাখার মত জায়গা সংকুলান হওয়ার কথা নয়। তাই হাত-পা থেকেও তিনি এমনরূপে আমাদের মাঝে ধরা দিয়েছেন। উপনিষদের ভাষায় বলতে হয়-
‘অপানিপাদো জাবানো গ্রহীতা
পশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃনোত্যকর্ণঃ।
স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা
তমাহুরগ্রং পুরুষং মহান্তম্ \
অর্থাৎ তাঁর লৌকিক হাত নেই অথচ তিনি সকল দ্রব্য গ্রহণ করেন। তাঁর পা নেই অথচ সর্বত্রই তিনি বিরাজমান। স্বাভাবিক চোখ কান নেই কিন্তু সবকিছুই তিনি দেখেন ও শুনেন। তাঁর আদি-অন্ত নেই। তিনি মহানপুরুষ। এজন্যই তাঁকে জানা কঠিন। উপনিষদের এই বর্ণনার প্রতীক রূপ হলো শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব। তাই তাঁর পুরো বিগ্রহ তৈরি করা সম্ভব হয় নি। শুধু প্রতীককেই দেখানো হয়েছে মাত্র। যার রথের চাকার সংখ্যা ১৬টি এবং রথের কাঠের সংখ্যা ২০৬টি। দেহতত্তে¡র দিক থেকে ১৬টি চাকা হলো দশ ইন্দ্রিয় ও ছয় রিপুর প্রতীক এবং ২০৬টি কাঠ হলো মানবদেহের ২০৬টি হাড়ের প্রতীক। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে প্রতি বছর অক্ষয়া তৃতীয়ার দিন পুরীর রথ তৈরীর কাজ আরম্ভ হয়ে থাকে। রথযাত্রার সমাপনান্তে এই রথটি ভেঙ্গে ফেলা হয়। আপাতদৃষ্টিতে এই রথটি ভগবানের চলাচলের জন্য একটি ক্ষুদ্র যান মনে হলেও এর সুগভীর আধ্যাত্মিক দিক রয়েছে। উপনিষদ প্রাণ ঋষিগণ তাইতো বলেছেন :
আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু।
বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্র গ্রহমবেচ \
আমাদের এই দেহটা হলো রথ, আর আত্মা হলো দেহরূপ রথের রথী তথা আরোহী, বুদ্ধি হলো রথের সারথী আর মন হলো এই দেহরথের লাগাম বা দড়ি। এই দেহরথকে সংসাররূপ রাস্তায় সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে গেলে ভক্তিকে হৃদয়ে স্থান দিতে হবে এবং গুরুপ্রদত্ত সাধনপথে প্রত্যেককে চলতে হবে। তাইতো বলদেবের রথ প্রথম চলতে দেখি। তিনি হলেন গুরুতত্ত¡, গুরুর নির্দেশিত পথ ধরে দেহরথ চললে ভয়ের আশংকা থাকেনা।
এই পৃথিবীতে মানব কল্যাণের জন্য আগত মহামানবেরা লোকশিক্ষার জন্য গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছেন। একমাত্র ভক্তিকে আশ্রয় করে গুরু কৃপা বলে দেহরথকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। জীবনে সাধন ভজনের প্রধান উপাদান হলো ভক্তি। ভক্তিতেই ঈশ্বর প্রীত হন। তাই সে অর্থে ভক্তি মহারাণী সুভদ্রা দেবীর রথকে চালিত হতে দেখি। ভক্তির মহাসমুদ্রে নিজেকে সমর্পণ করতে পারলেই গুরুকৃপা বলে পুর্নামৃতের আস্বাদন সম্ভব এবং হৃদয়ের গভীরে জগন্নাথ দর্শন সম্ভব অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মান্ডের অধিপতি তখন দেহরূপ রথে রথী হয়ে প্রকটিত হন। পলে পলে তখন কামনা-বাসনাযুক্ত ইন্দ্রিয়রূপ ঘোড়াসমূহকে বুদ্ধির জোরে মনরূপ রশি দ্বারা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আত্মরাজ্যে জগন্নাথরূপ মহাজ্যোতি ভক্ত দর্শন করতে পারে। ভক্তের তখন বার বার ভগবানে স্ফুর্তি হয়। ভক্তহৃদয় ভগবত প্রেমে পরিপূর্ণ হয়। চিত্তবৃত্তি কৃষ্ণাকর্ষিনী শক্তিতে রূপান্তর লাভ করে। সে অর্থে সবশেষে জগন্নাথদেবের রথে উঠে যাত্রা। রথযাত্রার আধ্যাত্মিক দিকটি সম্পূর্ণ জীবনভিত্তিক। দেহরূপ রথে তাঁকে অধিষ্ঠিত করে জীবনকে মঙ্গলের পথে ধাবিত করা। জীবন দুইয়ের মিলনে পূর্ণতা লাভ করে।
ভক্ত আর ভগবানের মিলনের মাধ্যমে অমৃততত্ত¡ লাভ করা যায়। অন্তর বাগানে অন্তরতমের সঙ্গে নিভৃত অভিসার হলো ভক্তজীবনের শ্রেষ্ঠ অভিসার। জীবন মাত্র ক্ষণকালের জন্যে। তাইতো জগন্নাথদেবের রথ অনুষ্ঠান পরবর্তী আমরা রথকে ভেঙ্গে ফেলতে দেখি। তাই চিরমুক্তির অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে ভক্তির মহারাজ্যে প্রিয়তম জগন্নাথকে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত করে জীবন রথকে পরিচালিত করতে হবে। তবেই ঈশ্বরের করুণা লাভ করা সম্ভব হবে। ইষ্টপথে যদি আমরা জীবনকে পরিচালনা করতে পারি তাহলে জীবন হবে রসময়, আনন্দময় এবং আধ্যাত্মিকতায় সমৃদ্ধ।
লেখক : ধর্মীয় বক্তা, কবি ও প্রাবন্ধিক