ডা. প্রধীর রঞ্জন নাথ
ব্রেস্ট ক্যানসার প্রতিকারে হোমিওপ্যাথিক ওষুধের প্রয়োগ সংকেত নিয়ে আজকের আলোচনা। ব্রেস্ট ক্যানসার এই একটি শব্দ রোজকার দিনযাপনের সব হিসেব নিকেশ উল্টে দেয় এক মুহূর্তে। এক অজানা অনিশ্চিত লড়াইড়ের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য তৈরি হতে হয়। গবেষণায় প্রমাণিত যে মহিলাদের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যানসারের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। তবে ব্রেস্ট ক্যানসার মানেই যে আপনি জীবনের গোধূলি লগ্নে পৌঁছে গেলেন, সেটি পুরোপুরি ঠিক নয়। প্রতিনিয়ত আপনাকে জুগিয়ে চলতে হবে বেঁচে থাকার রসদ। এই লড়াইয়ে প্রয়োজন সময়মতো চিকিৎসা নিয়মিত চেক আপ ও মনের জোর।
কেন হয় ব্রেস্ট ক্যানসার : ব্রেস্ট ক্যানসারের নির্দিষ্ট কোনও কারণ এখনও পর্যন্ত জানা যায় নি। তাই একাধিক কারণকে এ রোগের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। ব্রেস্ট ক্যানসারের সবচেয়ে বড় দুটি রিস্ক ফ্যাক্টর হল ১) সেক্স এবং ২) এজ। অর্থাৎ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের ব্রেস্ট ক্যানসারের প্রবণতা বাড়ে। তবে শুধু মহিলাদের নয়, স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারে পুরুষেরাও। যদিও সংখ্যাতত্তে¡র নিরিখে ব্যাপারটাকে নগন্য বলা যেতে পারে অনায়াসেই।
স্তন ক্যানসারের একটা সুবিধাজনক দিক হল একদম প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে (শরীরের অন্য কোথাও ছড়িয়ে না পড়লে) রোগ সারিয়ে তোলা যায় পুরোপুরিই। কিন্তু সচেতনার অভাবে এখনও শুধুমাত্র ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশেও ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মহিলাদের প্রতি ১২ জনের ১ জন মারা যান স্তন ক্যানসারে। আমাদের দেশের এই সংখ্যাটা যে বেশ কয়েকগুণ বেশি, সে কথা বলাই বাহুল্য। নিয়মিত সেলফ ব্রেস্ট এগ্জামিনেশন বা নিজে স্তন পরীক্ষার অভ্যেস গড়ে তুলতে পারলে প্রাথমিক অবস্থায় স্তনের সমস্যা ধরা পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করলে অনেক জটিলতাই এড়ানো যেতে পারেন।
কখন স্তন পরীক্ষা করতে হবে : কুড়ি বছর বয়সের পর থেকেই প্রতিটি মেয়ের সেলফ ব্রেস্ট এগ্জামিনেশন করা উচিত। বিশেষত যাঁদের বংশে মা, মাসি-পিসি / খালা-ফুফুদের কারও স্তন ক্যানসারের ইতিহাস আছে। মাসিক ঋতুচক্র শেষ হলে প্রতি মাসেই স্তন পরীক্ষা করতে হয়। আর যাঁদের মেনোপেজ হয়ে গেছে, অর্থাৎ ঋতু থেকে গেছে তাঁরা প্রতি মাসের একটি নির্দিষ্ট তারিখে সেলফ ব্রেস্ট এগজামিনেশন করবেন।
লক্ষণ : সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হল ব্রেস্টের লাম্প বা ফোলা কোনও অংশ, কোনও নির্দিষ্ট অংশের ত্বক পুরু হয়ে যাওয়া অথবা স্তনের যে কোনও অংশে কোনও গুটলির মতো শক্ত অংশ। আর বিরল কয়েকটি ক্ষেত্রে দু-একটি অদ্ভুত ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন স্তন ফুলে গিয়ে লালচে হয়ে ওঠে অথবা বাহুমূলে (বগলের নীচে) বড়সড় গ্ল্যান্ড (লিম্ফ নোড) দেখা যেতে পারে। তবে হ্যাং, এরকম উপসর্গ মানেই যে ব্রেস্ট ক্যানসার তা কিন্তু নয়। দেখা গিয়েছে একই রকম উপসর্গ থাকা সত্তে¡ও ব্রেস্টের লাম্পটি ক্যানসার নয়, সাধারণ টিউমার। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ যে, কোনওকরম লক্ষণ দেখা গেলে নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে অবিলম্বে উপযুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো কি কি : যাঁদের একটি স্তনে ক্যানসার হয়েছিল তাঁদের অন্যটিতে আক্রান্ত হওয়ার চান্স বেশি।
* অবিবাহিত এবং সন্তানহীনা মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যানসারের প্রকোপ বেশি। * ১২ বছরের আগে যাঁদের পিরিয়ড হয়েছে। * যারা ওভারওয়েট। * পরিবারে কারওর ব্রেস্ট ক্যানসারের হিস্ট্রি থাকলে, বিশেষ করে ২ জেনারেশনের মধ্যে খুব কাছের কারওর ব্রেস্ট ক্যানসার হয়ে থাকলে ৫০% রিস্ক বেড়ে যায়। * একই রকমভাবে যারা সন্তানকে কখনও স্তন্যপান করাননি তাঁদের ব্রেস্ট ক্যানসার বেশি হয়। আসলে স্তনের অন্যতম কাজ শিশুকে মাতৃদুগ্ধ দেওয়া। এ কাজটি ঠিকমত না হলেই সমস্যা হয়। * তিরিশ বছরের পরে যাঁরা প্রথমবার মা হয়েছেন তাঁদের স্তন ক্যানসারের প্রবণতা একজন কমবয়েসি মা হওয়া মহিলার থেকে অনেক বেশি। * খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে ব্রেস্ট ক্যানসারের একটি ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে। বেশি মশলাদার, তৈলাক্ত, ভাজাভুজি, চর্বিজাতীয় খাবার অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে এ রোগের ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায়। * যাঁরা ধূমপান করেন এবং দীর্ঘদিন ধরে বেশি করে মদ্যপান করেন, তাঁদের স্তন ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি। * স্তনের এক ধরনের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধিজনিত লাম্প দেখা যায়। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলা হয় প্রলিফারেটিভ অ্যাটিপিক্যাল হাইপারপ্লেশিয়া। এটি থাকলে ব্রেস্ট ক্যানসারের ঝুাঁকি প্রায় সাড়ে চারগুণ বেশি। * বয়স যত বাড়ে স্তন ক্যানসারের প্রবণতা ততটাই ঊর্ধ্বমুখী হয়। * মেনোপজের পরে বহুদিন ধরে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করালে আপনি ডেঞ্জার জোনে আছেন। * ৫ থেকে ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্রেস্ট ক্যানসারের জন্য দুধরনের জিন দায়ী ঃ বিআরসিএ ওয়ান আর বিআরসিএ টু
পরীক্ষা : যেমন ব্রেস্ট আলট্রাসাউন্ড, ম্যানোগ্রাফী ও বায়োপসির মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়।
প্রিভেনশন : ব্রেস্ট ক্যানসারের মোকাবিলায় প্রয়োজন কিছু প্রিভেনটিভ অ্যাকশন। ক্যানসারের মোকাবিলায় যোগাসনেরও ভূমিকা আছে।
* ওজন যেন আয়ত্বের মধ্যে থাকে। খুব কম বা খুব বেশি ওজন কাম্য নয়। প্রয়োজন নিয়মিত এক্সাইসাইজ। এক্সারসাইজ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হরমোনের মাত্রা ঠিক রাখে। * রিফাইন্ড গ্রেনের বদলে হোলগ্রেন আটার রুটি খান। * সারা দিনে বেশ কিছু ফল খান, ফলের মধ্যে যেন থাকে সাইট্রাস, বেরি। ডায়েটে যেন থাকে অনেক সবুজ সবজি। ব্রকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, পালংশাক, গাজর, টমেটো ইত্যাদি। * রেডমিট যথাসম্ভব কম খাবেন। অ্যালকোহলও চলবে না। * হাই ফাইবার সমৃদ্ধ সবজি যেমন বিনস বেশ ভাল। সয়া প্রডাক্ট, রোসেড সয়া নাট, সয়া মিল্ক, টোফু ইত্যাদি খান।
হোমিওপ্যাথিক প্রতিবিধান : হোমিওপ্যাথিমতে অসুখ হল শরীরের স্বাভাবিক প্রাণশক্তিতে বাধাদান বা অসুস্থকারী এক অপশক্তি। অস্ত্রোপচার করে আক্রান্ত স্থানটিকে বাদ দিলেও অনেক সময়েই অপর স্থানে বা শরীরের অন্য কোথাও ক্যানসার দেখা দিতে পারে। ব্রেস্ট ক্যানসারের ক্ষেত্রে এটি অনেকাংশে সত্যি। এই রোগ প্রতিকারে হোমিওপ্যাথিতে যুগান্তকারী ঔষুধ থাকলেও তা সফল প্রয়োগের উপর আরোগ্য সাফল্য নির্ভর করবে। এ রোগের ব্যবহৃত ঔষুধের নাম নিম্নে প্রদত্ত হল। যথা : ১) হোয়াংনান ২) ইউফোরবিয়া হেটারোভক্সিয়া ৩) ক্যালকেরিয়া অকজালিয়া ৪) ক্যালকেরিয়া অ্যাক্টিসোম ৫) ক্যালকেরিয়া কার্ব ৬) স্কোরিনাম ৭) এস্টেরিয়াস রুবিন ৮) ব্রোমিয়াম ৯) ফাইটোলা ১০) কোনিয়াম ম্যাকুলেটাম ১১) এপিস ১২) আর্সেনিক ১৩) হাইড্রাসটিস ১৪) ল্যাকেসিস ১৫) ফসফরাস ১৬) সিপিয়া ১৭) সালফার ১৮) থুজা ১৯) অরামমিউর ২০) ব্যারাইটা কার্বসহ আরো অনেক ফলদায়ক ওষুধ আছে। তারপরেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত¡াবধানে থেকে ওষুধ সেবন করা উচিত।
লেখক : হোমিও চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক