মনিরুল ইসলাম মুন্না
বেপরোয়া গতিতে চলাচল, হঠাৎ ব্রেকে দুর্ঘটনা, মূল সড়কে অন্যান্য যানবাহনের সাথে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা। এসব নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং অনলাইন মিডিয়ায় প্রচারের পরও কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি নগরীর চকবাজার কাপাসগোলা হিজলা খালে বেপরোয়া গতির একটি ব্যাটারি চালিত রিকশা খালে পড়ে ৬ মাস বয়সী এক শিশু নিহত হওয়ার পর ফের আলোচনায় এসেছে এই যানটি। ঘটনাটি নতুন করে সামনে এনেছে চট্টগ্রাম নগরীতে চলমান ব্যাটারি চালিত রিকশা নিয়ে নানা সমস্যা ও জটিলতা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, গতকাল রবিবার ট্রাফিকের চার বিভাগে ব্যাটারি রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয়। এসময় ট্রফিক উত্তর বিভাগে ১১২টি, দক্ষিণ বিভাগে ১০২টি, বন্দর বিভাগে ১৫টি এবং পশ্চিম বিভাগে ১৫৩টি রিকশা জব্দ করা হয়।
ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের পরিদর্শক (প্রশাসন) সুশোভন চাকমা পূর্বদেশকে বলেন, আমরা যানজট নিরসনে সর্বদা কাজ করে যাচ্ছি। মূল সড়কে রিকশা পেলেই জব্দ করে রাখছি। আমাদের এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
জানা গেছে, নগরীতে চলাচলকারী ৬০ হাজার ব্যাটারি চালিত রিকশা থেকে প্রতিদিন উঠছে কোটি টাকার চাঁদা। এ চাঁদার ভাগ স্থানীয় নেতাসহ বিভিন্ন মহলে পৌঁছালেও কেউ এর দায় কেউ নেয় না। অভিযুক্তদের প্রশ্ন করা হলে শুরু হয় সেই প্রচলিত প্রবাদ- ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’। তবে বিদ্যুৎ অপচয়, যানজট সৃষ্টি হচ্ছে আর প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। এছাড়া সরকারের রাজস্ব হারানোসহ নানা অভিযোগ থাকলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
চালকরা বলছেন, প্রতিদিন এই রিকশা থেকে একজন চালক গড়ে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা আয় করেন। তাদের মতে, পুনর্বাসনের উদ্যোগ না নিয়ে রিকশা বন্ধ করা হলে তা হবে তাদের ‘পেটে লাথি মারা’র শামিল। ফলে তারা আন্দোলনে যেতেও পিছ পা হবেন না।
তবে সমস্যার মধ্যেও বাস্তবতা হচ্ছে- এই ৬০ হাজার রিকশা চালকের পেছনে আছে প্রায় তিন লাখ মানুষের জীবিকা। যার মধ্যে- রিকশা চালকের পরিবার, গ্যারেজ ওয়ালা, মিস্ত্রি, যন্ত্রাংশ বিক্রেতাসহ অন্যান্য। তাদের দাবি, কর্মসংস্থানের বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া রিকশা বন্ধ করা মানে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া। এতগুলো পরিবারের কী হবে? এমন প্রশ্ন তাদের।
বাকলিয়া এলাকার ব্যাটারি রিকশা গ্যারেজের মালিক মো. শফিকুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, বর্তমানে যেভাবে ব্যাটারি রিকশা হয়েছে তা কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে না পুলিশ বা প্রশাসন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন যদি প্রথম অবস্থায় ব্যাটারি রিকশার চালকদের তালিকা করে লাইসেন্স বা অনুমোদন দিয়ে দিতো, তাহলে ছোট ছেলে, কিশোর, মহিলাসহ যে কেউ এভাবে বেপরোয়াভাবে রিকশা চালাতে পারতো না। এখন সিটি কর্পোরেশনে চাইলে শৃঙ্খলায় আনতে পারবে, তবে কঠিন হবে।
অপরদিকে ৫ আগস্টের পর নগরীতে ব্যাটারি রিকশা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ব্যর্থতাকে দুষছেন সাধারণ মানুষ। কেউ কেউ বলছেন, বিদ্যুৎ বিভাগের রহস্যজনক নীরবতা বিদ্যুৎ অপচয় রোধে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানজটের দায়ও কেউ নিচ্ছে না। যাত্রীরাও সময় বাঁচানো ও তুলনামূলক কম ভাড়ার কারণে এই ঝুঁকিপূর্ণ যানটিকে বেছে নিচ্ছেন। সিএনজি ট্যাক্সির চেয়ে ভাড়া কম হওয়ায় সাধারণ যাত্রীরা ব্যাটারি রিকশায় উঠতে বাধ্য হচ্ছেন। কম পুঁজি, বেশি আয়ের সুযোগে অনেকে এই পেশায় আসছেন। রিকশার মালিক হওয়ার আশায় অনেকেই দিনরাত কাজ করছেন। অনেকে শারীরিক দুর্বলতা ও নিদ্রাহীন অবস্থায় রিকশা চালাচ্ছেন।
দেখা গেছে, শিশু, যুবক ও বৃদ্ধসহ সব বয়সের মানুষ কর্মহীন হয়ে এই রিকশা চালনায় যুক্ত হচ্ছেন। রিকশা মালিকরা আবার বিভিন্ন লোভনীয় অফারের মাধ্যমে রিকশা ভাড়া দিয়ে থাকেন। নির্দিষ্ট কিস্তি পরিশোধ করলেই মালিক হওয়া যায়, এতে বাড়ছে রিকশার সংখ্যা। বর্তমানে ব্যাটারি রিকশা নিয়ে বিপাকে পড়েছে সিটি কর্পোরেশন ও ট্রাফিক বিভাগ। নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিলেই চালকরা সড়ক অবরোধের হুমকি দেন, এতে ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী। আর নিয়ন্ত্রণ না করলে বাড়ছে দুর্ঘটনা।
গত শুক্রবার শিশুর মৃত্যুর পর নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ, সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্টরা। সমাধানের পথ খুঁজতে শুরু করেছেন তারা।তবে সচেতন মহলের দাবি, সমাধান তখনই টেকসই হবে, যখন একদিকে জননিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং অন্যদিকে রিকশা চালকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।